
পররাষ্ট্র সচিব পদে পরিবর্তন আসছে। অস্বাভাবিক বিদায় পাচ্ছেন বর্তমান সচিব মো. জসীম উদ্দিন। সরকারের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অত্যাসন্ন পরিবর্তনের বিষয়টি মানবজমিনকে নিশ্চিত করেছেন।
জানিয়েছেন, ৮ মাসে তালগোল পাকিয়ে ফেলা পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দীনকে পরিবর্তনের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয় চলতি মাসের শুরুতে। গুরুত্বপূর্ণ ওই রদবদল বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মৌখিক নির্দেশনা বজ্রপাতের মতো এসে পড়ে সেগুনবাগিচায়। মুহূর্তেই তা ছড়ায় এক বিল্ডিং থেকে অন্য বিল্ডিংয়ে। যার প্রভাব পড়ে অধস্তনদের সেটআপে। অন্তর্বর্তী সরকারের আচমকা এমন সিদ্ধান্ত স্বভাবতই ব্যথিত করে মিস্টার জসীম উদ্দিনকে। ঘনিষ্ঠজনদের কাছে তিনি এমন প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত করেন। পেশাগত জীবনের একেবারে শেষ লগ্নে তিনি বিষয়টির সম্মানজনক সুরাহা চেয়েছেন বলে জানা গেছে।
তার ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন- পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের বিষয়টি জানাজানির পর থেকে ‘মনমরা’ অবস্থায় রয়েছেন জসীম উদ্দিন। তিনি মন্ত্রণালয়ে অফিস করছেন অনেকটা ‘না করার’ মতো। গত সপ্তাহে এবং চলতি সপ্তাহের খোলা দুইদিন সোম ও মঙ্গলবার কারও সঙ্গে তিনি তেমন দেখা-সাক্ষাৎ করেননি। বৈঠকাদিতেও খুব একটা অংশ নেননি বরং তিনি উপযুক্ত প্রতিনিধি পাঠাচ্ছেন। সচিবের নির্লিপ্ততার প্রভাব পড়ছে মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য রুটিন কার্যক্রমে। যা রীতিমতো হ-য-ব-র-ল অবস্থা দেখা দিয়েছে গোটা সেগুনবাগিচায়।
উদাহরণ হিসেবে এক কর্মকর্তা বলেন, চারদিনের সফরে আগামী ২৮শে মে জাপানে যাওয়ার কথা রয়েছে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের। সেই সফরের প্রস্তুতিমূলক আলোচনা ও দ্বিপক্ষীয় অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য আগামী ১৫ই মে টোকিওতে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক (ফরেন অফিস কনসালটেশন বা এফওসি) নির্ধারিত ছিল। এর নেতৃত্ব দেয়ার কথা ছিল পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিনের। কিন্তু সচিব নিজে যেতে পারছেন না বলে এফওসিই স্থগিত করে দেন! যা নিয়ে দুই সরকারের সম্পর্ক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যায়। অবশ্য প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের হস্তক্ষেপে স্থগিতের চিঠি প্রত্যাহার করা হয়েছে। এখন সেই বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নজরুল ইসলামকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। অবশ্য তাৎক্ষণিক পররাষ্ট্র সচিবের পরিবর্তে প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক বিশেষ সহকারী লুৎফে সিদ্দিকীকে সেই বৈঠকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল বৈঠকটি পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে না হয়ে প্রধান উপদেষ্টার সফরের প্রস্তুতিমূলক সভা হবে।
ওয়াকিবহাল সূত্রের দাবি উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেয়া অর্থাৎ সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত, পররাষ্ট্র সচিবের মর্যাদা এবং কূটনীতিক জসীম উদ্দিনের ক্যারিয়ার- সব কিছুর মধ্যে একটি সমন্বয়ের চেষ্টা করছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। এ নিয়ে ৩টি বিকল্প প্রস্তাব আলোচনার টেবিলে রয়েছে। এক পররাষ্ট্র সচিব নিজের সম্মান রক্ষায় ছুটিতে যাবেন। দুই. তাকে একটি দেশে রাষ্ট্রদূত পদে পদায়ন করা হবে। ৩. রাষ্ট্রদূত পদে পদায়নের আগ পর্যন্ত তিনি ফরেন সার্ভিস একাডেমির রেক্টরের দায়িত্ব পালন করবেন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বর্তমানে বার্লিনে রয়েছেন। আগামী ১৬ই মে দেশে ফিরবেন তিনি। তারপর সরকারের অ্যাকশন দৃশ্যমান হবে বলে ধারণা মিলেছে।
উল্লেখ্য, অনেক সিনিয়রকে ডিঙ্গিয়ে মো. জসীম উদ্দিনকে গত সেপ্টেম্বরে পররাষ্ট্র সচিব পদে নিয়োগ দেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। তাকে অনেকটা নীরবেই গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়। ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের পর প্রদেয় ওই নিয়োগে বিএনপি কানেকশনকে কাজে লাগিয়েছিল তার সুহৃদরা। অনেকটা নিঃশব্দে গত বছরের ৮ই সেপ্টেম্বর মো. জসীম উদ্দিনের নাম নতুন পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে জুড়ে দেয়া হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে। তখনো সাইটে তার নিয়োগ সংক্রান্ত অফিস আদেশের কপি যুক্ত হয়নি। স্মরণ করা যায়, আগামী বছরের ১২ই ডিসেম্বর তার অবসরোত্তর ছুটি শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। পররাষ্ট্র সচিব হওয়ার আগে তিনি চীনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তার আগে কাতার এবং গ্রিসে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পাালন করেছেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারের ত্রয়োদশ ব্যাচের কর্মকর্তা জসীম উদ্দিন নয়াদিল্লি, টোকিও, ওয়াশিংটন ডিসি এবং ইসলামাবাদে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অনুবিভাগের মহাপরিচালকসহ বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলেন তিনি। কনস্যুলার পরিষেবায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনায় রাষ্ট্রদূত জসীম উদ্দিনের নেতৃত্বে এথেন্সের বাংলাদেশ দূতাবাস ২০১৮ সালে ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে জনপ্রশাসন পুরস্কারও পায়। পুরো বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য পররাষ্ট্র সচিবের অ্যাপয়েনমেন্ট চাওয়া হয়। সন্ধ্যায় তার দপ্তরে দীর্ঘ অপেক্ষা করেন ওই প্রতিবেদক। কিন্তু বিদায়ের প্রস্তুতিতে থাকার কারণে সচিব কথা বলতে রাজি নয় বলে জানান তার দপ্তরের পরিচালক।