
স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে এখনো চলছে অস্থিরতা। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে এই খাত অনিয়ম ও লুটপাটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর নতুন করে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগে। হাসপাতাল পর্যায়েও চলছে নানা অরাজকতা। স্বাস্থ্য বিভাগ গত নয় মাস স্বাভাবিকভাবে তার কাজ করতে পারছে না, জনস্বাস্থ্য কর্মসূচিগুলোও বন্ধ, ছন্দপতন হয়েছে তার মূলকাজে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। চিকিৎসাসেবায় অব্যবস্থাপনা নিয়ে ক্ষুব্ধ স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নিজেও। তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে উপদেষ্টার তৎপরতাও দৃশ্যমান নয়।
ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে ৫ই আগস্ট সরকার পতনের পর অধিদপ্তর জুড়ে নানান দাবি আদায় আর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার কারণে তৈরি হওয়া অস্থিরতার মুখে পড়ে প্রশাসনিক কাজও।
স্বাস্থ্য খাতে বিশৃঙ্খলা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরাও। তারা বলছেন, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ এখনো নেই। এমন উদাসীনতা পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলতে পারে। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের উদ্যোগ নেয়া জরুরি। সম্প্রতি সিভিল সার্জনদের সমাবেশে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের তাগিদ দিয়েছেন।
স্বাস্থ্য খাতের পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক, জনস্বাস্থ্যবিদ, অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, স্বাস্থ্য খাত স্থবির পরিস্থিতি দেখছি। মুখ থুবড়ে পড়েছে এ খাতে। স্বাস্থ্যে যেটা হচ্ছে সেটা কাঙ্ক্ষিত নয়। নতুন কোনো উদ্যোগ দেখছি না। জসস্বাস্থ্য সম্পৃক্ত কর্মসূচিগুলো চলছে না। জলাতঙ্ক, যক্ষ্মা ও কালা জ্বরের মতো কর্মসূচির কথা তুলে ধরেন তিনি। এখানে হোঁচট খেয়েছে। তিন শনির দশায় পেয়ে বসেছে স্বাস্থ্য খাতকে। বিশ্ব সাহায্য-সহযোগিতা বন্ধ রয়েছে। এতে স্বাস্থ্য খাতের অপূরণীয় ক্ষতি দেখছেন এই বিশেষজ্ঞ। তিনি আরও বলেন, আগামী ১০-১৫ বছরেও এর থেকে উদ্বার করা যাবে না। স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এই সরকারের নিকট প্রত্যাশা ছিল অনেক। কিন্তু প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না। উল্টো স্বাস্থ্য খাত কঠিন হয়ে পড়ছে। সংক্রমণ-অসংক্রমণ ব্যাধি ঝুঁকিতে রয়েছে। আমার মনে হয়, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার স্বাস্থ্য খাতকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে না। এই খাতকে গুরুত্ব দিয়ে সমস্যার সমাধান করতে হবে। স্থবিরতা দূর করতে হবে দ্রুত।
এদিকে, চিকিৎসাসেবায় অব্যবস্থাপনা ও জনভোগান্তি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। বাংলাদেশ চক্ষু চিকিৎসক সমিতির (ওএসবি) এক অনুষ্ঠানে তিনি গতকাল এই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রোগী ভর্তি থেকে শুরু করে অন্যান্য সেবা এখনো সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য নয়। চিকিৎসকরা সময়মতো হাসপাতালে যান না। তারা যদি নিয়মিত নিজেদের দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করতে না পারেন তাহলে স্বাস্থ্যসেবায় কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হবে না। তিনি চিকিৎসকদের পেশাগত দায়িত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং কাঠামোগত সংস্কারের আহ্বান জানান। সংস্কার নিজের ভেতরে হতে হবে, তারপর যেখানে দরকার সেখানে। না হলে শুধু রাজা বদল হবে, কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। চিকিৎসকদের বেতন বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, দ্রুত কার্যকর হবে বলে আশা করছি। কিন্তু বেতন না বাড়া পর্যন্ত কি চিকিৎসা বন্ধ থাকবে? স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বলেন, ৭ হাজার চিকিৎসককে পদোন্নতির সিদ্ধান্ত হয়েছে।
আন্দোলন আন্দোলন খেলা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে: সরকারিভাবে দেশের স্বাস্থ্য খাত পরিচালনা ও তদারকির সার্বিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হয় রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে। হাসপাতাল নিবন্ধন, চিকিৎসক পদায়ন ও বদলির মতো প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডও পরিচালিত হয় এই অধিদপ্তর থেকেই। আওয়ামী লীগের আমলে এই সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় ছিলেন সরকার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা। সরকার পতনের পর থেকে আওয়ামী লীগপন্থি হিসেবে পরিচিত এসব কর্মকর্তা কর্মস্থলেই আসেনি। এদিকে শুরু থেকেই শীর্ষস্থানীয় এসব কর্মকর্তার পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন আওয়ামী লীগ আমলে বঞ্চিত ও ভিন্নমতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দাবি ও আন্দোলনের চাপে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কার্যক্রম অনেকটাই অচল হয়ে পড়ে। মাসখানেক ধরে বন্ধ ছিল যাবতীয় কার্যক্রমও। কিন্তু এখনো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পুরোপুরি গতি নিয়ে কাজ করছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানান, স্বাস্থ্য খাতে আগামী ৫ বছরের জন্য কর্মপরিকল্পনা (অপারেশনাল প্ল্যান) প্রণয়ন করা হলেও চলমান পরিস্থিতিতে সেটি অনুমোদন করার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। গত জুলাই মাসেই এটি অনুমোদনের কথা ছিল। কিন্তু তা না হওয়ায় সারা দেশের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।
নতুন সরকার গঠনের পর বিভিন্ন দাবি আদায়ে নানা কর্মসূচি এবং নিজেদের বঞ্চিত দাবি করা চিকিৎসক ও কর্মচারীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা পরিস্থিতিকে আরও জটিল ও অস্থিতিশীল করে তুলেছে। এসব কারণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে চিকিৎসা কার্যক্রমেও।
স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, স্বাস্থ্য খাতে শীর্ষ পদগুলোতে দলীয় লোকজন বসানোর চর্চা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। যারা দলীয় রাজনীতি করে তাদেরই সরকার পদে বসায়, উপযুক্ত বা অনুপযুক্ত যাই হোক। এ কারণে নতুন সরকার আসলে একটা অস্থিরতা তৈরি হয়। যারা নিজেদের বঞ্চিত মনে করে তারা চায় সেখানে তাদের বসানো হোক। বিষয়টির সমাধান না করলে ধারাবাহিকভাবে চলতেই থাকবে। মাঝখানে রোগীদের ভোগান্তি হয়।
হাসপাতালে সেবা নিশ্চিত করার চেয়ে চিকিৎসকরা ব্যস্ত পদায়ন, পদোন্নতি ও দাবিদাওয়া নিয়ে। বিভিন্ন ব্যানারে একের পর এক দাবি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে বেশ চাপেই রেখেছেন তারা। কখনো কর্মবিরতির ডাক দিচ্ছে ‘বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ফোরাম’ কখনো আন্দোলনে নামছে ‘ডক্টরস মুভমেন্ট ফর জাস্টিস’। আবার কখনো সামনে আসছেন মেডিকেলের শিক্ষার্থী ও ইন্টার্নরা।
এসব আন্দোলনের পেছনে নানান মহল নানাভাবে মদত দিচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এসব বিষয়ে মুখোমুখি অবস্থানে না গিয়ে সবার সমস্যা সমাধানে নজর দিচ্ছেন তারা। যাতে চিকিৎসা খাতে সেবাটা স্বাভাবিক থাকে। সমপ্রতি বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ফোরামের আন্দোলন ঠেকাতে তাদের সঙ্গে বসেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী সায়েদুর রহমান। এতে উভয়পক্ষ সম্মত হয় যে, ১. ঈদের আগে/পরে প্রায় চার হাজার চিকিৎসকের প্রথম ধাপে প্রমোশন হবে। ২. পছন্দক্রম থাকুক বা না থাকুক মাদার পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারীদের সাব-স্পেশালিটিতে (যে বিষয়গুলোতে ডিগ্রি নেই) প্রমোশন দেয়া হবে। আগে পছন্দের বাইরে কোনো প্রমোশন না দেয়ার সিদ্ধান্ত ছিল এবং প্রার্থী পদ পরিবর্তনেরও সুযোগ ছিল না। ৩. ওয়ান স্টেপ প্রমোশন হবে। অর্থাৎ সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক এবং অধ্যাপক হবেন আপাতত একবার। ৪. প্রমোশনের পর কেস টু কেস ধরে ধারণাগত জ্যেষ্ঠতা দেয়া হবে। ৫. ১৫ বছর ধরে অন্যায় সুবিধাভোগী চিকিৎসকদের যদি আবারো প্রমোশন হয় সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সোসাইটির আপত্তির ভিত্তিতে প্রমোশন স্থগিত থাকবে। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান গণমাধ্যমের সামনে ৮ই মার্চ ঘোষণা দেন যে, আগামী ১২ সপ্তাহের মধ্যে ৭ হাজার ৫০০ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের জন্য সহকারী, সহযোগী ও অধ্যাপক পদে সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টির মাধ্যমে পদোন্নতির ব্যবস্থা করা হবে। পিএসসির মাধ্যমে নতুন দুই হাজার চিকিৎসক নিয়োগের প্রক্রিয়াও চলমান।
সার্বিক বিষয়ে জানতে গতকাল প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক সায়েদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি টেলিফোনে কথা বলতে রাজি হননি।