Image description

কোরবানির ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে ততই পশুর খামারিদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। কারণ মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ৫ই আগস্টের পর জামিনে মুক্তি পাওয়া ডাকাতরা। প্রায়ই বিভিন্ন যানবাহন আটকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে যাত্রীদের সব লুট করছে তারা। মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়ার পাশাপাশি নারী যাত্রীদের শ্লীলতাহানির ঘটনাও ঘটছে। দুই সপ্তাহ পরেই শুরু হবে পশুবাহী গাড়ির আনাগোনা। গ্রামাঞ্চল থেকে পশুভর্তি ট্রাক নিয়ে কারবারিরা ঢাকার বিভিন্ন হাটে আসবেন। পশুবাহী এসব গাড়ি নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে ব্যাবসায়ীদের মধ্যে। কারণ ডাকাতরা গরু ডাকাতি করে অন্য হাটে নিয়ে বিক্রি করার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া এই সময় খামারিরা পশু বিক্রির টাকাও বহন করবেন। জাল টাকার কারবারিররা কৌশলে গরুর হাটে জাল টাকা ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করতে পারে। অন্যদিকে অজ্ঞানপাটির্, মলমপার্টি, ছিনতাই চক্রের সদস্যরাও তৎপর থাকবে। সবমিলিয়ে কোরবানি ঈদের আগেই মহাসড়ক আতঙ্কের শহরে পরিণত হয়েছে। যদিও  হা্‌ইওয়ে পুলিশ বলছে, আতঙ্ক ভয় থাকবেই। তবে নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। জামিনে মুক্তি পাওয়া পুরাতন অন্তত ১৪০০ ডাকাতের তালিকা রয়েছে হাইওয়ে ও জেলা পুলিশের কাছে। এসব তালিকা ধরে ডাকাতদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। অনেক ডাকাতকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহাসড়ক নিয়ে অতীতের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের মহাসড়কগুলোতে একের পর এক ঘটনা আলোচিত হয়েছে। নানা অপ্রীতিকর ঘটনায় যাত্রী, কারবারি, যানবাহনের চালক সবাই আতঙ্কিত। মহাসড়ককে নিরাপদ করার জন্য অতীতেও পুলিশ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। জনসচেতনতায় মাইকিং, পোস্টারিং, অত্যাধুনিক সিসি ক্যামেরা, নিরাপত্তা টহল বাড়িয়েও নিরাপদ করা যায়নি মহাসড়ক। মহাসড়কের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা হাইওয়ে পুলিশের কাছে নেই পর্যাপ্ত জনবল। তাই তাদের সীমিত সংখ্যক জনবল ও ধার করে আনা জনবল দিয়ে জেলা পুলিশের সঙ্গে সমন্বিতভাবে হাইওয়ে নিরাপদ করার কাজ চলছে। হাইওয়েকে নিরাপদ করার জন্য পুলিশ ছক তৈরি করলেও জনবলের অভাবে অনেক সময় বাস্তবায়ন করা যায় না। 

হাইওয়ে পুলিশ সূত্র জানায়, চাহিদার তুলনায় সীমিত সংখ্যক জনবল নিয়ে কাজ চলছে। তবে কিছু বাড়তি ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। জনসচেতনতা তৈরির পাশাপাশি সারা রাত টহল, সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে পর্যবেক্ষণ, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, তালিকাভুক্ত ডাকাতদের তালিকা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। অন্যান্য বছর শুধু যাত্রীবাহী যানবাহন নিয়ে চ্যালেঞ্জ থাকলেও কোরবানি ঈদে যাত্রীবাহী যানবাহনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পশুবাহী গাড়ি। পশুবাহী গাড়ি যাতে ডাকাতরা নিয়ে যেতে না পারে সেজন্য বড় বড় খামারের মালিক, গরু কারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের পরামর্শ  দেয়া হয়েছে। 

হাইওয়ে পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. দেলোয়ার হোসেন মিঞা মানবজমিনকে বলেন, রোজার ঈদে আমাদের কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল একটা। কীভাবে ঘরমুখো মানুষকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছানো যায়। কিন্তু এবার আমাদের সামনে দুটো চ্যালেঞ্জ। মানুষ ঢাকা থেকে বাড়িও যাবে আবার গ্রামাঞ্চল থেকে গাড়িভর্তি গরু ঢাকায় আসবে। দুই দিক দিয়ে আমাদের নিরাপত্তা দিতে হবে। তাই সেটি মাথায় রেখে আমরাও প্রস্তুতি নিয়েছি। এ জন্য আমরা নিরাপত্তা ছক তৈরি করেছি। ইতিমধ্যে আমাদের সদস্যরা মাঠে কাজ শুরু করেছে। কিছুদিনের মধ্যে বাকিরাও কাজে যোগ দিবে। আশা করছি কোনো পশুবাহী গাড়ি বা যাত্রীবাহী গাড়িতে ডাকাতি হবে না। তিনি বলেন, আমরা এবারো সমন্বিতভাবে জেলা পুলিশের সঙ্গে মিলে কাজ করবো। প্রত্যেকের জন্য কাজ করার আলাদা জায়গা ঠিক করে দিবো। কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, গাইবান্ধা, রংপুর, লালমনিরহাট, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ এলাকা থেকে ঢাকায় গরু বেশি আসে। আমরা বড় বড় খামারিদের সাথে যোগাযোগ করেছি। কীভাবে তারা ঢাকায় গরু নিয়ে আসবে সেটা বলে দেয়া হয়েছে। হাট কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও আমরা সমন্বয় করছি। ছিনতাই চাঁদাবাজি রোধে ৮ থেকে ১০টা গাড়ি একসঙ্গে পুলিশের সিকিউরিটিতে হাটে পৌঁছে দেয়া হবে। জাল টাকার যাতে সমস্যা না হয় সেজন্য জেলা পুলিশ ও ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করছি। বড় অঙ্কের টাকা বহনের সময় মালিকরা যাতে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেটিও বলা হয়েছে। এ ছাড়া সড়কের পরিস্থিতি বুঝার জন্য সিভিলে আমরা পুলিশ সদস্যদের গাড়িতে উঠিয়ে দিবো। আমরা এখন পর্যন্ত ৭০০ ফোর্স কাজে লাগিয়েছি। আরও ৩০০ ফোর্স কাজে লাগানো হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১৪২৭টি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। মাওয়া এক্সপ্রেস রোডে ৬৫০টি বসানো হয়েছে। এ ছাড়াও অন্যান্য মহাসড়কে ক্যামেরা বসানো হয়েছে। বিশেষ বিশেষ কিছু স্থানে ক্যামেরা বসানো হয়েছে। এ ছাড়াও হাটকেন্দ্রিক আওে কিছু ক্যামেরা বসানো হবে। ডাকাত আতঙ্ক নিয়ে তিনি বলেন, ডাকাত আতঙ্কতো থাকবেই। তবে আশা করছি এবার ডাকাতি হবে না। কারণ ডাকাতিপ্রবণ এলাকাগুলোতে আমরা বেশি নজর দিয়েছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২০০৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২০ বছরে মহাসড়কে ডাকাতির বিভিন্ন ঘটনায় জড়িত ১ হাজার ৪শ জনের একটি তালিকা করা হয়েছে। তাদের বিষয়ে জেলা পুলিশকেও অবহিত করা হয়েছে। জেলা পুলিশ ও আমরা ডাকাতদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করছি। আশা করি, গত ঈদের মতো আগামী ঈদুল আজহায়ও অপরাধমুক্ত ও স্বস্তির সঙ্গে যাত্রা করতে পারবে সাধারণ যাত্রী এবং পশুবাহী পরিবহন।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত খবর বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশের বেশির ভাগ মহাসড়কে ডাকাতি ও ডাকাতিচেষ্টার ঘটনা ঘটেছে। এসময় ডাকাতদলের হানায় আহত হওয়ার সংখ্যাও কম নয়। তবে ডাকাতির ঘটনা অনেক হলেও মামলা এবং গ্রেপ্তারের সংখ্যা কম। হাইওয়ে পুলিশের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে দেশের আটটি মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনায় ১৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪১ জনকে। সমপ্রতি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দাউদকান্দি থেকে চৌদ্দগ্রাম এবং নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ অংশে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে। এসব ঘটনা যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মহাসড়কের সোনারগাঁয়ের হটস্পট খ্যাত কাঁচপুর থেকে মেঘনা টোলপ্লাজা পর্যন্ত প্রায়ই ঘটছে ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা। আগস্ট পরবর্তী সময়ে রাত হলেই এ মহাসড়ক দিয়ে চলাচলকারী যাত্রী ও চালকদের প্রায়ই পড়তে হচ্ছে ডাকাত ও ছিনতাইকারীর কবলে। ঢাকা-রাজশাহী, রাজশাহী-নওগাঁ ও রাজশাহী-বগুড়া মহাসড়কে নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে চরম উদ্বেগে রয়েছেন যাত্রী, পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা। গত তিন মাসে এসব রুটে রাতের বেলায় চলাচলকারী যানবাহনে একের পর এক ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। যানজটে আটকা পড়া বাসেও ডাকাতি হয়। নারী যাত্রীদের শ্লীলতাহানির মতো ঘটনাও সামনে এসেছে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভার অংশ, বিশেষ করে ব্যাংক টাউন ও পুলিশ টাউন এলাকাটি বর্তমানে যাত্রীদের কাছে আতঙ্কের হয়ে উঠেছে। একের পর এক বাসে ডাকাতির ঘটনায় নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানো যেন এখন দুঃস্বপ্ন। শুধু এই রুটেই গত দুই মাসে পাঁচটি ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ঘটেছে দিনে-দুপুরে ডাকাতির ঘটনাও। অথচ এই মহাসড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যেও ঘটেছে ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা। 

প্রবাসীরাও ঝুঁকিতে: পুলিশের সূত্রগুলো বলছে, ডাকাতদলের সর্দারদের কিছু প্রতিনিধি ঢাকা বিমানবন্দরে অবস্থান করে। কোনো প্রবাসী যখন সড়ক পথে বাড়ি যাওয়ার জন্য ভাড়া করা গাড়িতে রওয়ানা দেন, তখন প্রতিনিধি গাড়ির তথ্যসহ যাবতীয় সর্দারের কাছে পাঠিয়ে দেয়।  এ ছাড়া তাদের একজন গাড়ি টার্গেট করে আরেকটি গাড়িতে পিছু নেয়। আর আগে থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে সর্দারের নেতৃত্বে আরেকটি টিম। কখনো তারা পুলিশ, ডিবি, র‌্যাবের পোশাকে অবস্থান নেয়। সুবিধাজনক স্থানে ওই প্রবাসীর গাড়ি পৌঁছামাত্র তারা ডাকাতি করে সব ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ২৬শে ফেব্রুয়ারি ভোরে মহাসড়কের সোনারগাঁ পিরোজপুর ইউনিয়নের আষাড়িয়ারচর এলাকার সাধু পেপার মিলের সামনে সিরাজুল ইসলাম নামে এক কুয়েত প্রবাসী ডাকাতির শিকার হন। সেই রাতে ভুক্তভোগীকে বহনকারী গাড়িতে হামলা চালিয়ে পাসপোর্টসহ প্রায় পাঁচ লাখ টাকা মূল্যের মালামাল লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। ওই রাতেই অসুস্থ বোনকে চিকিৎসা করিয়ে বাড়ি যাওয়ার সময় মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া থেকে আসা এক নারী ও তার দেবর ছিনতাইয়ের শিকার হন।