
চৌদ্দ ঘণ্টা প্লেন জার্নির পর চিকিৎসকদের পরামর্শে পূর্ণ বিশ্রামে আছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। লন্ডন ক্লিনিকের চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র এবং এভারকেয়ার হাসপাতালে খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী বাসায়ই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা চলবে।
দলটির একজন চিকিৎসক গতকাল জানিয়েছেন, বেগম জিয়া ১৪ ঘণ্টার জার্নিতে কিছুটা ক্লান্ত ছিলেন। তবে পূর্ণ বিশ্রামের মধ্য দিয়ে মানসিক ও শারীরিকভাবে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। খালেদা জিয়ার অনুমতি পেলে দলের সিনিয়র নেতারা শিগগিরই তার সাথে সাক্ষাৎ করবেন বলে জানা গেছে। গতকাল বুধবার বেলা পৌনে ৩টার দিকে খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এ বি এম আবদুস সাত্তারকে ফিরোজায় প্রবেশ করতে দেখা গেছে। এ ছাড়া দলের কোনো নেতাকে ফিরোজায় প্রবেশ করতে দেখা যায়নি। তবে নেতাকর্মীদের কেউ কেউ বাসায় প্রবেশ করতে না পারলেও বাড়ির সামনে গিয়ে ছবি তুলছেন।
এ দিকে লন্ডন থেকে খালেদা জিয়ার সাথে তার দুই পুত্রবধূ ডা: জুবাইদা রহমান ও সৈয়দা শর্মিলা রহমান দেশে এসেছেন। এতে বেগম জিয়া মানসিকভাবেও বেশ উৎফুল্ল আছেন। এর আগে দেশে ফেরার সময় লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে বড় ছেলে তারেক রহমানের সাথে হাসিমুখে কথা বলেন মা খালেদা জিয়া। সেখানে তিনি তারেক রহমানের কাছে জানতে চান, তুমি কবে দেশে ফিরবে? মা তার সন্তানকে বিদায় বেলায় গালে আদর করে দেন। তারেক রহমানও মাকে বিদায় জানানোর মুহূর্তে জড়িয়ে ধরেন। এ সময় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, ‘ভাইয়ার (তারেক রহমান) দিকে খেয়াল রেখো।’ ১৭ বছর ধরে লন্ডনে থাকা তারেক রহমান শিগগিরই দেশে ফিরে আসবেন, এমন প্রত্যাশায় রয়েছেন খালেদা জিয়া।
চিকিৎসার জন্য চার মাস লন্ডনে কাটিয়ে মঙ্গলবার দেশে ফেরেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। ওই দিন সকাল ১০টা ৪০মিনিটে বিএনপি চেয়ারপারসনকে বহনকারী কাতার আমিরের পাঠানো এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এরপর বেলা সোয়া ১১টায় বিমানবন্দর থেকে রওনা হয়ে গুলশানের বাসায় পৌঁছান বেলা ১টা ২৬ মিনিটে। বিমানবন্দরে নামার পর নেতাকর্মীদের প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে শুভেচ্ছায় সিক্ত হতে হতে গুলশানের বাসভবন ‘ফিরোজায়’ পৌঁছাতে খালেদা জিয়ার প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে যায়।
চিকিৎসা শেষে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দেশে ফিরে আসায় নেতাকর্মীদের মনোবল দ্বিগুণ বেড়েছে বলে মনে করে বিএনপি। একই সাথে দলও আরো চাঙ্গা হয়েছে বলে দাবি নেতাকর্মীদের। তারা মনে করেন, তিনি দলে ঐক্যের প্রতীক। সুতরাং তিনি রাজনীতিতে থাকুন বা না থাকুন, দেশে তার উপস্থিতিটাই তাদের কাছে বড় ধরনের আশীর্বাদের মতো।
খালেদা জিয়া দলীয় চেয়ারপারসন থাকলেও দীর্ঘ অসুস্থতা এবং আইনি বাধ্যবাধকতায় দীর্ঘ সময় ধরে রাজনীতিতে তিনি সেভাবে সক্রিয় নন। তিনি রাজনীতির মাঠে অভিভাবকতুল্য ভূমিকা রেখে আসছেন। নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা, খালেদা জিয়া এখন দেশে ফিরে এসেছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরসন এবং দেশের গণতন্ত্রে উত্তোরণে তিনি ভূমিকা রাখবেন।
বিএনপি নেতারা জানান, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বর্তমানে বিএনপিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। লন্ডন থেকে তিনি ভার্চুয়ালি দল পরিচালনা করছেন। তবে দেশে তার শারীরিক অনুপস্থিতিতে নেতাকর্মীদের মধ্যে একধরনের শূন্যতা অনূভূত হয়। খালেদা জিয়া দেশে থাকলে সেটি পূরণ হয়ে যায়।
নেতাকর্মীরা আশা করছেন, খালেদা জিয়ার শারীরিক সুস্থতা অব্যাহত থাকবে এবং আগামী দিনের রাজনীতিতে তিনি প্রয়োজন অনুযায়ী নির্দেশনা দিয়ে যাবেন। আগামীতে জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে রাজনীতি, সেই নির্বাচনে বিএনপির রোল কী হবে, সে ক্ষেত্রে তিনিও ভূমিকা রাখবেন।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। এরপর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়া গত ৮ জানুয়ারি থেকে ৫ মে পর্যন্ত লন্ডনে ছিলেন; অর্থাৎ চার মাস তিনি দেশে ছিলেন না। চিকিৎসার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসনের এই বিদেশ যাওয়াকে তখন মাইনাস-টু ফর্মুলা হিসেবেও দেখা হচ্ছিল। কোনো কোনো পক্ষ বলছিল, শেখ হাসিনার পলায়নের পর চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াও বিদেশ যাওয়ায় দেশে একধরনের রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরির চেষ্টা চলছে। কিন্তু চিকিৎসা শেষে বেগম জিয়া দেশে ফিরে আসায় সেই ক্যাম্পেইন, প্রোপাগান্ডা ভেস্তে গেছে।
দলীয় চেয়ারপারসনকে কাছে পেয়ে নেতাকর্মীরা দারুণ উচ্ছ্বসিত, উৎফুল্ল। গত মঙ্গলবার তারা রাজপথে যে উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা দেখিয়েছেন, সেটি নেত্রীর প্রতি তাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। তিনিই যে রাজনৈতিক আশ্রয়ের স্থল, নেতাকর্মীরা উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে সেটি প্রমাণ করেছে।
নেতাকর্মীরা বলছেন, খালেদা জিয়া এখন শুধু বিএনপির চেয়ারপারসনই নন, তিনি এখন জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কট এবং সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে সরকারের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর যে মতবিরোধ, সেখানে বেগম জিয়াই একমাত্র সমাধান। রাজনীতিতে তার যে প্রভাব, তিনিই আগামী দিনে ঐক্যের মধ্য দিয়ে একটা সুষ্ঠু অবস্থার দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে পারবেন এবং বাংলাদেশও গণতন্ত্রে উত্তোরণ করতে পারবে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, বর্তমানে সংস্কার এবং নির্বাচনকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর একটি চেষ্টা হচ্ছে। তারা গণতন্ত্রকে একটু দূরে রাখতে চান। আর আমরা গণতান্ত্রিক অধিকারটাকে ফিরে পেতে চাই। সেটি ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতভিন্নতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। যেহেতু জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বেগম খালেদা জিয়াকে দেশের সবাই আস্থায় নেন, সে দিক থেকে বলতে গেলে উনি লন্ডনে চার মাস চিকিৎসা শেষে দেশে এসেছেন। এখন উনি সার্বিক পরিস্থিতি অবহিত হয়ে যেভাবে পরবর্তী নির্দেশনা দিবেন, সেটা বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে একটা নতুন পথনির্দেশনা হবে বলে মনে করি।
দলের যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়ার ভূমিকা অনস্বীকার্য। উনি সব সময় ভূমিকা পালন করছেন। ওনার ভূমিকার কারণে বাংলাদেশের রাজনীতির মোড় বিভিন্ন সময় ঘুরে গেছে। বিভিন্ন সময় অবৈধ, অনৈতিক ও কর্তৃত্ববাদী সরকার তাদের মতো করে; যা করতে চেয়েছে, বেগম জিয়ার ভূমিকার কারণে সেটা ঘুরে গেছে এবং জনগণের যে শাসন, সেটিই বারবার কায়েম হয়েছে। তার সাহসিকতা, তার দেশপ্রেম ও তার চিন্তাশক্তি যে কতটা প্রখর, সেটি অতীতে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। ছাত্র-জনতার যে গণ-অভ্যুত্থান, সেটাও হয়েছে গণতন্ত্রের প্রশ্নে খালেদা জিয়ার অনড় অবস্থানের কারণে। তিনি আরো বলেন, খালেদা জিয়া অসুস্থতার চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরেছেন। আমরা দেখলাম, উনি গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে ফিরোজায় যাচ্ছেন। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, এর মধ্য দিয়ে রাজনীতিও বোধহয় হাঁটা শুরু করেছে। বর্তমানে সংস্কার নিয়ে নানা কথাবার্তা হচ্ছে, নির্বাচন নিয়েও একধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে, এটির সমাপ্তি ঘটবে এবং অতিদ্রুত দেশের গণতন্ত্রে উত্তোরণ ঘটবে।