Image description

আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) চূড়ান্ত করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। ওই বছরের জন্য ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা এডিপি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত কয়েক বছর উন্নয়ন বাজেটে অবহেলিতই ছিল শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা।

কিন্তু আগামী অর্থবছরের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার এ দুই খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বরাদ্দ পাওয়া শীর্ষ ৫ খাতের মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে শিক্ষা, পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে স্বাস্থ্য খাত। এ বছর মোট বরাদ্দের ৭১ শতাংশই পাচ্ছে পাঁচ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ।

গতকাল মঙ্গলবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বর্ধিত সভায় এডিপি চূড়ান্ত করা হয়। সভা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। বর্ধিত সভায় সভাপতিত্ব করেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। সভায় পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

গত কয়েক বছরের এডিপিতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সবচেয়ে কম বরাদ্দ পেয়ে আসছিল। গত কয়েক বছরের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এ দুই খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর সুপারিশ থাকলেও তা এড়িয়ে অন্য খাতগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া এডিপিতে প্রথমবারের মতো উন্নয়ন বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য শীর্ষ পাঁচে স্থান পেয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। কারিগরি শিক্ষা বাস্তবায়নের গুণগত মান ঠিক রাখা জরুরি।

সভা সূত্র বলছে, খাতভিত্তিক বরাদ্দের ক্ষেত্রে অন্য সময়ের তুলনায় এবারও পরিবহন ও যোগাযোগে সর্বোচ্চ ২৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে। এ খাতের বরাদ্দ ৫৮ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বরাদ্দ ১৪ শতাংশ বা ৩২ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা।

তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ ১২ দশমিক ৪২ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে শিক্ষা খাতে। এ খাতের বরাদ্দ ২৮ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা। যদিও চলতি অর্থবছর মূল এডিপিতে এ খাতের বরাদ্দ ছিল মাত্র ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ। মোট এডিপির ৯ দশমিক ৯ শতাংশ বরাদ্দ পেয়ে চতুর্থ অবস্থানে গৃহায়ন ও কমিউনিটি সুবিধাবলি খাত। এ খাতের বরাদ্দ ২২ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা। ৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ বরাদ্দ পেয়ে পঞ্চম শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে স্বাস্থ্য খাত। এ খাতের বরাদ্দ ১৮ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান আমার দেশকে বলেন, এডিপির সাইজ না বাড়িয়ে এটিকে আরো বাস্তবভিত্তিক করা হচ্ছেÑ এটি ইতিবাচক। বাস্তবায়ন যাতে ভালোভাবে হয়, সেদিকে নজর দেওয়া হচ্ছে; এটি অবশ্যই ভালো। শিক্ষা-স্বাস্থ্যে অগ্রাধিকার দিয়ে যে কাঠামোগত পরিবর্তন করা হচ্ছে, এটা যুক্তিসংগত। বিশেষত শিক্ষার উন্নয়নে যদি বিনিয়োগ থাকে এবং কারিগরি শিক্ষায় নজর থাকে, তাহলে এটি আমাদের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক ফলাফল নিয়ে আসবে।

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, স্বাস্থ্য খাতে আমাদের ১০০ টাকার মধ্যে ৭০ টাকা নিজের পকেট থেকে দেয়। দক্ষিণ এশিয়ায় এটি সর্বোচ্চ। যার অর্থ হলো সরকারি স্বাস্থ্য ব্যয় তুলনামূলকভাবে কম। মানুষকে ব্যক্তিগত ব্যয় দিয়েই করতে হয়। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যেরও যে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে, তা ইতিবাচক। সাধারণ মানুষ তুলনামূলকভাবে এতে বেশি উপকৃত হবেন।

মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, আগামী অর্থবছরের জন্য মোট প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে এক হাজার ১৪২টি। আগামী অর্থবছরে এডিপি প্রণয়নের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পরিবেশবান্ধব টেকসই উন্নয়ন। এক্ষেত্রে প্রকল্প গ্রহণের জন্য উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, দারিদ্র্য নিরসন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে জোর দেওয়া হয়েছে।

অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এবার কয়েকটি খাতকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে কৃষিভিত্তিক প্রকল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আইসিটি এবং পরিবহন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। তাছাড়া এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অগ্রাধিকার ও অঞ্চলভিত্তিক সুষম উন্নয়নকে এবারের এডিপিতে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এবারের এডিপি প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিদেশি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৮৬ হাজার কোটি টাকায় নামানো হয়েছে। তবে প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে বিদেশি ঋণের প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এছাড়া গতকালের বর্ধিত সভায় একইরকমের প্রকল্পের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন প্রকল্প না নিয়ে গুচ্ছ আকারে প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, মন্ত্রণালয় ও বিভাগভিত্তিক বরাদ্দের ক্ষেত্রে এবারের এডিপিতে পাঁচ মন্ত্রণালয় ৭১ শতাংশ বরাদ্দ পেয়েছে। তবে এবার শিক্ষায় জোর দিয়ে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা এডিপি বরাদ্দ হয়েছে। এর মধ্যে এক লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে পাঁচ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ।

সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া বিভাগগুলোর মধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগ পেয়েছে সর্বোচ্চ ৩৬ হাজার ৯৮ কোটি টাকার বরাদ্দ। এটি মোট এডিপির ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ। তবে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির (আরএডিপি) ৩৬ হাজার ২৬৮ কোটির তুলনায় তা দশমিক ৪৭ শতাংশ কম। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৪ শতাংশ বরাদ্দ রয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের জন্য। এ বিভাগের বরাদ্দ রয়েছে ৩২ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা। চলতি এডিপির ১৮ হাজার ৬২৪ কোটির তুলনায় এ বিভাগের বরাদ্দ ৪২ দশমিক ৩৯ শতাংশ বেড়েছে। তৃতীয় সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ৮২ শতাংশ বরাদ্দ রয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগের জন্য। এ বিভাগের বরাদ্দ ২০ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা। চলতি আরএডিপির তুলনায় বিদ্যুৎ বিভাগে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ বরাদ্দ কমেছে।

আগামী অর্থবছরের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে ৫৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এ বিভাগের জন্য মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৩ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। এটি মোট এডিপির ৫ দশমিক ৯২ শতাংশ। এ খাতের জন্য চলতি আরএডিপিতে বরাদ্দ রয়েছে ৫ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা। পঞ্চম সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ বরাদ্দ রয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জন্য। এ মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১২ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরের মূল এডিপি ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটির তুলনায় আগামী অর্থবছরের জন্য ৩৫ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের তুলনায় এডিপি বরাদ্দ কমেছে ১৩ দশমিক ২১ শতাংশ। প্রকল্প ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ১৪ শতাংশ কমিয়ে ৮৬ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। সরকারি অর্থায়ন ১২ দশমিক ৭৩ শতাংশ কমিয়ে এক লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে।

সভা সূত্র বলছে, এবার মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো থেকে প্রকল্পগুলোর জন্য মোট চাহিদা ছিল ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়নের চাহিদা ছিল এক লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা। সে তুলনায় যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে চাহিদা ছিল ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি। আর সরকারি অর্থায়নের চাহিদা ছিল ১০ দশমিক ৪২ শতাংশ বেশি।