
জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হত্যার ঘটনায় অন্তত ৭৪ টি মামলার তদন্ত করছে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট — পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন ( পিবিআই ) । এসব ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের অধিকাংশের লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয়েছে । ময়নাতদন্ত না হওয়ায় হত্যা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা কিছুটা বিপাকে পড়ছেন । মামলার প্রয়োজনে লাশের ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে স্বজনদের বাধার সম্মুখীনও হচ্ছেন তাঁরা । এতে মামলাগুলোর অধিকাংশই নিষ্পত্তি করতে হচ্ছে ময়নাতদন্ত ছাড়াই । পিবিআই বলছে , বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের অনেককেই ঘটনার পরপর ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করে ফেলা হয়েছে । মামলার নিষ্পত্তির জন্য ময়নাতদন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । কিন্তু যেসব মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয়েছে , আবেগ - অনুভূতির কারণ দেখিয়ে সেগুলোর ময়নাতদন্ত করতে দিচ্ছেন না নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা ।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গত বছরের ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নম্বর গেটের সামনে গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদ । এতে ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে এবং শেষদিকে তা সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয় । ১৬ জুলাইয়ের পর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনের মধ্যে অনেক হত্যা , হত্যাচেষ্টা ও হামলার ঘটনা ঘটে ।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র এবং গত ২৮ এপ্রিল এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক ( আইজিপি ) বাহারুল আলমের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী , বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হত্যা ও হত্যাচেষ্টার মামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগে সারা দেশের বিভিন্ন থানা ও আদালতে ১ হাজার ৪৬০ টি মামলা হয়েছে । এর মধ্যে ৬৩১ টি হত্যা মামলা । এসব মামলার মাত্র দুটির অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে । রংপুরে মো . আবু সাঈদ হত্যা , সিলেটে সাংবাদিক আবু তাহের মো . তুরাব হত্যাসহ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ৭৪ টি হত্যা মামলার তদন্ত করছে পিবিআই । এর মধ্যে মাত্র ২০ টির ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেয়েছে সংস্থাটি ।
বাকি ৫৪ টি মামলার লাশের ময়নাতদন্ত হয়নি । এতে হত্যা মামলাগুলো তদন্তে কিছুটা জটিলতায় পড়তে হচ্ছে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের । ময়নাতদন্ত ছাড়াই মামলা নিষ্পত্তি করতে হচ্ছে তাঁদের । এ ধরনের কোনো মামলার অভিযোগপত্র জমা দিতে পারেনি পিবিআই । বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গত বছরের ১৯ জুলাই রাজধানীর মিরপুর ৬ নম্বরে রাজপথে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন একটি বেসরকারি এনজিওর কর্মী শেখ মো . সাকিব রায়হান । সাকিবের বাবা শেখ আজিজুর রহমান ময়নাতদন্ত ছাড়াই ছেলের লাশ নিয়ে খুলনায় গ্রামের বাড়িতে দাফন করেন ।
সাকিব হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক ( এসআই ) মো . ইদ্রিস আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ ময়নাতদন্তের জন্য পুলিশ স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় লাশ তুলতে চাইলে পরিবার বাধা দেয় । ফলে ময়নাতদন্ত করা সম্ভব হয়নি । তবে অন্যান্য তথ্য - উপাত্ত সংগ্রহসহ মামলার তদন্তকাজ চলছে । '
গত ৫ আগস্ট রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ী থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মিস্ত্রি মো . রাসেল বকাউল ( ২২ ) । ময়নাতদন্ত ছাড়াই তাঁর লাশ চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয় । রাসেল হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক মোহাম্মদ শাহীনুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন,‘ এখন রাসেলের পরিবার লাশ তুলে ময়নাতদন্ত করতে দিতে রাজি নয় । তবে আমরা লাশ উত্তোলনের বিষয়ে আদালতের নির্দেশ মেনেই কাজ করব । আইনগত প্রক্রিয়া মেনেই মামলার তদন্তকাজ চলছে ।’ এখন লাশ তুলে ময়নাতদন্ত করতে না দেওয়ার বিষয়ে এনজিওকর্মী সাকিব রায়হানের বাবা আজিজুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ হত্যার ভিডিও , ছবিসহ নানা তথ্য রয়েছে । সারা দেশের মানুষ জানে কারা হত্যা করেছে । এখানে লাশ তুলে ময়নাতদন্তের প্রয়োজন পড়ে না । তাই লাশ উত্তোলন না করার আবেদন জানানো পর পুলিশ লাশ তোলেনি । আমরা হত্যার বিচারের অপেক্ষায় আছি । ’
পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন , অনেক মামলার তথ্য- প্রামাণ্য না পাওয়ায় পিবিআইয়ের পক্ষে সেসব মামলায় সংশ্লিষ্ট আসামিকে সরাসরি অভিযুক্ত করার বিষয়টি কিছুটা জটিল । তবে ময়নাতদন্ত ছাড়াও অন্য যেসব বিষয় রয়েছে , সেগুলো দিয়ে মামলার তদন্তের কাজ চলছে । পিবিআই সূত্রে জানা যায় , হত্যা মামলার বাইরেও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকেন্দ্রিক অন্যান্য অভিযোগে বিভিন্ন থানায় হওয়া ২ শতাধিক মামলার তদন্ত করছে পিবিআই । এসব মামলার মোট ৪ হাজার ৮৩০ আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৭৮০ জনকে । রংপুরের আবু সাঈদসহ আলোচিত কিছু হত্যাকাণ্ডের ভিডিও এবং ছবিযুক্ত তথ্যপ্রমাণ থাকায় দ্রুত তদন্তকাজ চলছে । তবে ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও হত্যাসহ বিভিন্ন মামলায় এখন পর্যন্ত একটিরও অভিযোগপত্র দিতে পারেনি পিবিআই ।
ময়নাতদন্ত নিয়ে এ সমস্যার প্রেক্ষাপটে মামলার তদন্তের বিষয়ে পিবিআইয়ের অতিরিক্ত আইজিপি মো . মোস্তফা কামাল আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ হত্যা মামলায় ময়নাতদন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । সে সময় অনেক মামলায় ময়নাতদন্ত হয়নি । কিছু লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে । ময়নাতদন্ত না করতে পরিবারের অনুরোধের কারণে কিছু লাশের ময়নাতদন্ত করা যায়নি । তবে অন্য যেসব সংশ্লিষ্ট বিষয় রয়েছে সেগুলো দিয়ে ময়নাতদন্তের কাজ চলবে । এতে কোনো অসুবিধা হবে না । ময়নাতদন্ত ছাড়া হত্যা মামলার অভিযোগ প্রমাণ করার বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ এস এম শাহজাহান আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ ময়নাতদন্ত না থাকলেই যে হত্যা মামলার বিচার হবে না আইনে এমন কিছু নেই । ময়নাতদন্ত হলো ঠিক কী কারণে মৃত্যু হলো তা নির্দিষ্ট করে জানা । সে সময় মামলা করার পরিস্থিতি ছিল না । একটা মামলা প্ৰমাণ করতে যেসব সাক্ষ্যপ্রমাণ লাগে , তা যদি পাওয়া যায় তাহলে ময়নাতদন্ত ছাড়াও বিচার হতে পারে । ’