
রাষ্ট্র সংস্কারের বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষ করে সংবিধান সংস্কারসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবগুলোয় দ্বিমত পোষণ করেছে বিএনপিসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপে দলগুলো কিছু প্রস্তাবে একমত হলেও তা বাস্তবায়নের বিষয়টি জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দিতে বলেছে।
কয়েকটি প্রস্তাব নিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির মধ্যে ত্রিমুখী অবস্থান তৈরি হয়েছে। এ মতপার্থক্যের জেরে কিছু বিষয়ে ঐকমত্য কমিশন ছাড় দেওয়ার চিন্তাও করছে। এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বলেছে, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে, শুধু সেগুলোর ওপর ভিত্তি করেই জাতীয় সনদ তৈরি করা হবে।
সংবিধান সংস্কার, বিচার বিভাগ, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন ও দুর্নীতি দমনসংক্রান্ত সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় ধারাবাহিক সংলাপ করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গত ২০ মার্চ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির সঙ্গে মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে এ সংলাপ শুরু হয়। এ পর্যন্ত ২৫টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে সংলাপ সম্পন্ন করেছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশনের পক্ষে ধারাবাহিক সংলাপে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এর সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। আগামী ১৫ মের মধ্যে প্রথম ধাপের সংলাপ শেষ হবে বলে এর আগে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন তিনি।
সংস্কার কমিশন তাদের কার্যক্রম নিয়মিত বিরতিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অবহিত করছে। গত ২৮ এপ্রিল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে কমিশনের পক্ষ থেকে সার্বিক কার্যক্রম অবহিত করা হয়। সে সময় প্রধান উপদেষ্টা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যে পৌঁছে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় সনদ তৈরির নির্দেশনা দেন।
এর আগে ঐকমত্য কমিশন পাঁচটি সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের ওপর রাজনৈতিক দলের সুনির্দিষ্ট মতামত জানাতে সুপারিশগুলো ১৬৬ প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে স্প্রেডশিট আকারে ৩৯টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে পাঠায়। এর মধ্যে ৩৫টি দল ও জোট সাড়া দেয় বলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা পবন চৌধুরী আমার দেশকে নিশ্চিত করেন। রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি অনলাইনে সাধারণ নাগরিকদের মতামত নেবে ঐকমত্য কমিশন। সংলাপ ও অনলাইনে পাওয়া মতামতের ভিত্তিতে যেসব বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে, তার ভিত্তিতে জুলাই সনদ তৈরি হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংলাপে অংশ নেওয়া সবগুলো রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে একমত পোষণ করেছে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত তিন মাস নাকি নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত চার মাস হবে, এটা নিয়ে দলগুলোর বিভক্তি রয়েছে। এদিকে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বিষয়ে মতৈক্য থাকলেও এ সরকারের প্রধান, সদস্য সংখ্যা ও নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে রয়েছে দলগুলো। সংলাপে অংশ নেওয়া মাহমুদুর রহমান মান্না নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্যসহ হাতেগোনা দুয়েকটি দল বাদে সবাই দ্বিপক্ষবিশিষ্ট সংসদের পক্ষে মত দিয়েছে। তবে উচ্চকক্ষের সদস্য সংখ্যা কত হবে এবং তাদের প্রতিনিধিত্ব কীভাবে নির্বাচিত হবে, তা নিয়ে দলগুলোর মতপার্থক্য রয়েছে।
জানা গেছে, সংস্কার কমিশন তার প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয় সভাপতি একক ব্যক্তি থাকতে পারবেন না বলে যে সুপারিশ করেছে, তাতে সায় দেয়নি বিএনপিসহ সমমনা কয়েকটি দল। প্রধানমন্ত্রীর কাছে সংসদ নেতার পদ রাখার পক্ষে বিএনপি। দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি হবেন কি না, তা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ওপর ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে দলটি। অন্যদিকে, এনসিপি এ দুটি পদ আলাদা করার পক্ষে মত দিয়েছে। তাদের মতে, এটি সংসদীয় কাঠামোতে আরো বেশি ভারসাম্য ও জবাবদিহি নিশ্চিত করবে। জামায়াত জানিয়েছে, এ বিষয়ে তাদের অবস্থান এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তারা কমিশনের সঙ্গে আরো আলোচনা করবে।
বিএনপিসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যের পক্ষে মত দিলেও ভারসাম্য প্রশ্নে সংস্কার কমিশন যেসব ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে, তার সবগুলোর সঙ্গে দলগুলো একমত নয়।
জামায়াত এবং এনসিপি প্রধানমন্ত্রী পদের দুই মেয়াদের সীমা নির্ধারণে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে একমত হয়েছে। তবে বিএনপি বলেছে, টানা দুই মেয়াদ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকা যেতে পারে, তবে তৃতীয় মেয়াদের জন্য অন্তত একটি মেয়াদ বিরতি দিতে হবে। অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ প্রশ্নে বিএনপির অনড় অবস্থানে কমিশন থেকে সর্বোচ্চ তিন মেয়াদের কথা বলে নতুন একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে পরপর দুবার এবং মাঝে বিরতি দিয়ে আরেকবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন বলে প্রস্তাব দেওয়া হয়। বিএনপি বিষয়টিতে কিছুটা নমনীয় বলে জানা গেছে।
প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ পাঁচ বছর করার পক্ষে মত দিয়েছে বিএনপি ও জামায়াত। অন্যদিকে এনসিপি মেয়াদ চার বছর করার প্রস্তাবকে সমর্থন করেছে।
সংবিধান সংস্কার কমিশন বলেছিল, তাদের সংস্কার প্রস্তাব তৈরির অন্যতম লক্ষ্য ছিল প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে এবং রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের (আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ) মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা। এ-সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু সুপারিশের সঙ্গে বিএনপি একমত হয়নি।
ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা ও বিচার বিভাগÑ রাষ্ট্রের এ তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ (এনসিসি) গঠন করার প্রস্তাব দিয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এ প্রস্তাবের ওপর কমিশন বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছে। তবে বিএনপি এনসিসি গঠনের প্রস্তাবের সরাসরি বিরোধিতা করেছে। তাদের মতে, এটি প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা হ্রাস এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি করতে পারে।
কমিশনের সঙ্গে সংলাপের পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ গঠনের প্রস্তাবে বিএনপি একমত নয়। কারণ রাষ্ট্র পরিচালনার মূল দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর ওপর ন্যস্ত। এ অবস্থায় একাধিক কর্তৃপক্ষ সৃষ্টি হলে দ্বৈত শাসনব্যবস্থা তৈরি হবে বলে মনে করে দলটি। অন্যদিকে নবগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপি প্রস্তাবটির পক্ষে মত দিয়েছে। তারা মনে করে, গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতিমুক্ত করার জন্য এটি জরুরি। জামায়াতে ইসলামীও কিছুটা সংশোধনসাপেক্ষে এনসিসি সংবিধানে যুক্ত করার পক্ষে।
বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দল এবং ইসলামি দলগুলোর সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘বহুত্ববাদ’ যুক্ত করার প্রস্তাবের ঘোর বিরোধিতা রয়েছে। এর বদলে তারা ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর আগের অবস্থা যেভাবে ছিল, সে অনুযায়ী ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস’ বাক্যটি ফিরিয়ে আনার পক্ষে মত দিয়েছে।
জামায়াতও চায় সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর সম্পূর্ণ আস্থা এবং বিশ্বাস স্থাপন’ কথা যুক্ত করা হোক। অবশ্য দলটি এ বিষয়ে কমিশনের সঙ্গে আংশিকভাবে একমত পোষণ করে ‘বহুত্ববাদ’ শব্দের বদলে ‘বহুসংস্কৃতিবাদ’ অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছে। এনসিপিও কমিশনের সঙ্গে আংশিকভাবে একমত হয়েছে। তবে দলটির মত, ইংরেজি শব্দ প্লুরালিজমের বাংলা অনুবাদ আরো স্পষ্টভাবে করা উচিত। শব্দটি কিছু রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে।
বিচার বিভাগে সংস্কার বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছে বিএনপি। কমিশন প্রধান বিচারপতি নিয়োগে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে বেছে নেওয়ার প্রস্তাব দিলেও বিএনপি এ পদে তিনজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতির মধ্য থেকে একজনকে মনোনয়ন দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে।
এ ছাড়া বিএনপি বিচারপতি নিয়োগে একটি ‘জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশন’ গঠনের পক্ষে মত দিয়েছে। তবে তারা বলেছে, এ কমিশনের কাঠামো ও কার্যপরিধি সংসদে আলোচনা করে চূড়ান্ত করতে হবে। এ বিষয়গুলোয় জামায়াত ও এনসিপি কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গেই একমত পোষণ করেছে।
সংবিধান সংশোধনে দুই কক্ষের অনুমোদনের পর গণভোট করা, জরুরি অবস্থা জারির প্রস্তাবিত বিধান, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা নামে আলাদা অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা, সংবিধানে দেশের নাম পরিবর্তন, নিম্নকক্ষে তরুণদের জন্য ১০ শতাংশ আসনে মনোনয়ন দেওয়া, সংসদ নির্বাচনের জন্য ন্যূনতম বয়স ২১ বছর করার মতো প্রস্তাবগুলোয় বিএনপি একমত হয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা করতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহবান জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। গতকাল ১২ দলীয় জোটের সঙ্গে সংলাপ তিনি বলেন, ১৫ মের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনা শেষ করা হবে।
ঐকমত্যে আসার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে ছাড় দেওয়ার আহবান জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমাদের সবাইকে এক জায়গায় আসতে হবে। আমরা সব বিষয়ে একমত হতে পারব না, কিন্তু রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক জায়গায় আমাদের একমত হয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার আমার দেশকে বলেন, আমাদের অনেকগুলো রাজনৈতিক দল ও শক্তি রয়েছে। তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব অবস্থান আছে, দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তারা তাদের মতো করে মতামত দেবে এটাই স্বাভাবিক। সবাইকে একত্রিত করার কাজটি দুরূহ, তবে আমরা আশাবাদী।