
গ্যাস সংকটে উৎপাদন ও রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। গ্যাস সংকটের প্রভাব এবং উত্তরণের উপায় নিয়ে সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সাবেক সভাপতি ও বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির চেয়ারম্যান আব্দুল হাই সরকার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবু হেনা মুহিব
সমকাল : গ্যাস সংকট আসলে কোন পর্যায়ে?
আব্দুল হাই সরকার: শিল্পে গ্যাস সংকট অনেক পুরোনো। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ সব সময়ই কম ছিল। সরবরাহ সংযোগও স্বাভাবিক ছিল না। তবে সম্প্রতি সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। গ্যাসের চাপ অনেক কম। জেনারেটর চালানোর মতো ন্যূনতম চাপও থাকছে না। চাহিদার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশের বেশি গ্যাস পাওয়া যায় না। তুলা থেকে সুতা তৈরি, সুতা থেকে কাপড় তৈরি, ডায়িং, কাটিং, ওয়াশিং, পোশাক উৎপাদন– সব ক্ষেত্রে গ্যাস প্রয়োজন। এসব প্রক্রিয়ায় এখন উৎপাদন গড়ে ৭০ শতাংশ কম হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে শিল্পের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়। উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি, ব্যাংক, বীমা, কর্মসংস্থান– পুরো অর্থনীতিই হুমকিতে রয়েছে।
সমকাল : পরিস্থিতি সামাল দিতে আপনারা কী করছেন?
আব্দুল হাই সরকার: বাধ্য হয়ে ডিজেল দিয়ে কিছু জেনারেটর চালু রাখার চেষ্টা করছি। পল্লী বিদ্যুতের সহায়তায় কিছু জেনারেটর চালু করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে গ্যাসের চেয়ে তিন গুণ বেশি ব্যয় হয়। একে তো ব্যয় বেশি, আবার ভারী শিল্পে দীর্ঘ সময় এভাবে উৎপাদন চালানো সম্ভব নয়। মাঝে মাঝে সিএনজি স্টেশন থেকে গ্যাস নিয়ে কিছুটা সময় কাজ চালানোর চেষ্টা করছেন উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ।
সমকাল : নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গ্যাস সংকটই কী প্রধান বাধা?
আব্দুল হাই সরকার: হ্যাঁ, গ্যাস সংকটই প্রধান বাধা। এর বাইরে অবকাঠামো, আমলাতান্ত্রিক মারপ্যাঁচ, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা– এমন আরও কিছু বাধা আছে। তবে কোনোটাই গ্যাস সংকটের চেয়ে বড় নয়। একটা উদাহরণ দেই। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে একটি আধুনিক মানের টেক্সটাইল মিলের অন্যান্য অবকাঠামো আমি তৈরি রেখেছি কয়েক বছর আগে। শুধু গ্যাসের অভাবে কারখানাটি চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। এই কারখানার জন্য ২০ লাখ ঘনমিটার গ্যাসের লোড চেয়ে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু এখনও গ্যাস পাইনি। চালু করা গেলে বছরে ১০ কোটি ডলার রপ্তানি আয় আসত। সরাসরি ছয় হাজার লোকের কর্মসংস্থান হতো। এ রকম অনেক নতুন বিনিয়োগ উৎপাদনে আসতে পারছে না গ্যাসের অভাবে।
সমকাল : অন্তর্বর্তী সরকার বিনিয়োগ আকর্ষণে পদক্ষেপ নিচ্ছে। গ্যাস সংকটের সমাধান ছাড়া বিনিয়োগ আকর্ষণ সম্ভব হবে?
আব্দুল হাই সরকার: আমাদের যত সম্ভাবনা এবং তৈরি পোশাক শিল্পে যে কাঠামো এত দিনে দাঁড়িয়েছে, তাতে বিনিয়োগ টানতে বাড়তি পদক্ষেপের প্রয়োজন ছিল না। মুনাফার আকর্ষণেই এ দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আসত। তবে গ্যাস সংকটে সেই সম্ভাবনা মুখ থুবড়ে পড়ছে। এ সমস্যা সমাধান না করে অন্য কোনো পদক্ষেপ ফল দেবে না। অতীতে এ ধরনের পদক্ষেপের অভিজ্ঞতা ভালো হয়নি। যেভাবেই হোক গ্যাসের স্থায়ী সমাধান করতে হবে। আমাদের দেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে বলে আগে আমরা যে কথাটা শুনতাম, তা অমূলক নয়। সিলেটে গ্যাস আছে, ভোলায় আছে, সমুদ্রের তলদেশে আছে। আরও যেখানে যেখানে আছে, সেগুলো অনুসন্ধান করতে হবে। বিদেশি বিশেষজ্ঞ এবং অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠান দিয়ে গ্যাস অনুসন্ধান, উত্তোলন ও সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের নিজস্ব গ্যাস উত্তোলন ছাড়া ভালো বিকল্প নেই। এটি আগেই প্রয়োজন ছিল। সিদ্ধান্তহীনতা বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্বলতার কারণে নিজস্ব গ্যাস উত্তোলনে আমরা যেতে পারিনি। এর সঙ্গে ভূরাজনীতিও আছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনও ঢাকায় এসে আমাদের তৎকালীন সরকারের কাছে গ্যাস রপ্তানির অনুরোধ জানিয়েছিলেন।
সমকাল : নিজস্ব গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহ দীর্ঘ প্রক্রিয়া। ততদিন শিল্প চলবে কীভাবে? আপাতত সমাধান কী?
আব্দুল হাই সরকার: খুব বেশি দীর্ঘ সময় লাগবে না। হয়তো দুই থেকে তিন বছর লাগতে পারে। বিদেশি অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিলে হয়তো আরও কম সময়ের মধ্যে মাটির নিচের গ্যাসকে সরবরাহ লাইনে নিয়ে আসা সম্ভব হবে। আপাতত স্বল্পমেয়াদি সমাধান হিসেবে এলএনজি আমদানি দিয়েই চালিয়ে নিতে হবে। পর্যাপ্ত এলএনজি আমদানি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে শিল্পে কোনো সংকট না থাকে। এ সুযোগ বলে রাখি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বাণিজ্যিক মনোভাব থেকে আমাদের পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের যে প্রক্রিয়া চলছে, তা থেকে সুরক্ষায় যদি আমরা আমদানিতে ভারসাম্য আনতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলএনজি আমদানি বাড়াতে থাকি, তাহলে তা ঠিক হবে না। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ থেকে আমদানি করা সহজ ও সাশ্রয়ী। সেখান থেকে ১০ হাজার মাইল দূরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গ্যাস আনা বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হবে না। একই কথা তুলার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মার্কিন তুলার দাম বেশি। আসতে সময় বেশি লাগে। এ কারণে প্রতিযোগিতার বাজারে মার্কিন তুলা আমাদের জন্য লাভজনক নয়। কোনো কারণে আমরা বাণিজ্যিকভাবে পিছিয়ে পড়লে ভারত সেই সুবিধা নিতে চায়। ভারত তাদের বস্ত্র ও তৈরি পোশাক শিল্পে ব্যাপক সহায়তা দিচ্ছে।