Image description

চোরাই পথে আসা ব্যান্ডউইথ ব্যবহার বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। অবৈধ ব্যান্ডউইথ বন্ধে আগামী ৫ দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনকে (বিটিআরসি) নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি মনিটরিংয়ের আওতায় না থাকা আইটিসিগুলোকে (ইন্টারন্যাশনাল টেরিস্ট্রিয়াল কেবল) কার্যকর মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অংশ হিসেবে আনমনিটর্ড আইটিসিগুলোর পপগুলোতে হঠাৎ হঠাৎ পরিদর্শন এবং এসব অবৈধ কারবারে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রয়োজনে গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তা নেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

গতকাল রোববার বিটিআরসিকে দেওয়া চিঠিতে এসব নির্দেশনা দিয়েছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। বিটিআরসির চেয়ারম্যান বরাবর দেওয়া চিঠিতে দৈনিক কালবেলায় ‘ব্যান্ডউইথও আসছে চোরাই পথে’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। সূত্র হিসেবে দৈনিক কালবেলায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটির পেপার কাটিংও যুক্ত করা হয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের টেলিকম শাখার উপসচিব মো. মামুনুর রশিদ স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘গত ৩০ এপ্রিল দৈনিক কালবেলায় ‘ব্যান্ডউইথও আসছে চোরাই পথে’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এমতাবস্থায়, দৈনিক কালবেলায় প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণসহ আনমনিটর্ড আইটিসিগুলোকে কার্যকর মনিটরিংয়ের আওতায় আনার মাধ্যমে চোরাই পথে আসা ব্যান্ডউইথ ব্যবহার বন্ধ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অংশ হিসেবে যশোর রোড, কিংবা কুয়াকাটায় আনমনিটর্ড আইটিসিগুলোর পপগুলোতে হঠাৎ হঠাৎ পরিদর্শন, এসব ব্যবসায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে প্রয়োজনে গোয়েন্দা সংস্থার সাহায্য গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’

এর আগে গত ৩০ এপ্রিল দৈনিক কালবেলায় ‘ব্যান্ডউইথও আসছে চোরাই পথে’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অবৈধভাবে ব্যান্ডউইথ আনছে একটি চক্র, যার নেতৃত্বে রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কয়েকটি আইটিসি ও আইআইজি অপারেটর। সরকারের অনুমতি ছাড়াই বিপুল ব্যান্ডউইথ সীমান্ত দিয়ে এনে বিক্রি করা হচ্ছে আইআইজি ও আইএসপিদের কাছে।

বিটিআরসির দুর্বল নজরদারির সুযোগে গড়ে উঠেছে এই চোরাচালান নেটওয়ার্ক। বছরে শত শত কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্য হলেও সরকার পাচ্ছে না কোনো রাজস্ব। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার জন্য অপ্রদর্শিত ব্যান্ডউইথ বাজার বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নিয়ম অনুযায়ী, আইটিসি অপারেটরদের আমদানিকৃত ব্যান্ডউইথ এনটিটিএন ব্যবস্থার মাধ্যমে আইআইজি অপারেটরদের কাছে পৌঁছানোর কথা। বিটিআরসির গাইডলাইন অনুযায়ী, আইটিসি অপারেটর ছাড়া অন্য কোনো লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের ব্যান্ডউইথ আমদানির সুযোগ নেই। কিন্তু বেনাপোলে ডিভাইস স্থাপনের অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও আইটিসি অপারেটরদের স্থাপনায় ডিভাইস বসিয়ে অবৈধভাবে ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্যারিয়ার’ থেকে ব্যান্ডউইথ আমদানি করা হচ্ছে। এই কাজে তাদের সহায়তা করছে আইটিসি অপারেটররা, যা বিটিআরসির গাইডলাইনের পুরোপুরি ব্যত্যয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিদিন ঠিক কত পরিমাণ ব্যান্ডউইথ দেশে ঢুকছে, তা মনিটরিংয়ের কোনো প্রযুক্তিগত সক্ষমতা নেই বিটিআরসির। ফলে সীমান্ত পেরিয়ে অবাধে নিয়ে আসা ব্যান্ডউইথের একটি বড় অংশ বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে সরকারি রাজস্বের বাইরে থেকে। দেশে সাবমেরিন কেবল বা বৈধ রুটে আসা ব্যান্ডউইথের চেয়ে তুলনামূলক কম দামে এই অবৈধ ব্যান্ডউইথ বিভিন্ন অপারেটর ও করপোরেট ব্যবহারকারীদের কাছে বিক্রি করে চোরাচালান চক্রের প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তুলেছে শতকোটি টাকার অবৈধ ব্যান্ডউইথ বাজার।

অবৈধভাবে ব্যান্ডউইথ আমদানি চক্রে জড়িত রয়েছে আইটিসি ও আইআইজি (ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে) প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশেষ করে সামিট, ফাইবার অ্যাট হোম, নভোকম ও বিডি লিংকের পাশাপাশি উইন্ডস্ট্রিম, স্টারটেক, আর্থ, লেভেল থ্রি—এসব প্রভাবশালী আইটিসি ও আইআইজি প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি জড়িত রয়েছে অবৈধ ব্যান্ডউইথ আমদানিতে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত ২২ ফেব্রুয়ারি বিটিআরসির এনফোর্সমেন্ট অ্যান্ড ইন্সপেকশন ডিরেক্টরেট ডিভিশনের তিন সদস্যের একটি দল অভিযান চালায় সীমান্ত এলাকার কয়েকটি আইটিসি প্রতিষ্ঠানের স্থাপনায়। অভিযানে অবৈধভাবে ব্যান্ডউইথ আমদানির প্রমাণ পেয়ে বিডিলিংক, আর্থ ও লেভেল থ্রি—এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের ৩০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ বিচ্ছিন্ন করা হয়।

বিটিআরসি সূত্রের বরাতে ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও বেনাপোলে থাকা আইটিসিগুলোর স্থাপনা অবৈধভাবে ব্যবহার করছে বিভিন্ন আইআইজি প্রতিষ্ঠানগুলো। আইটিসি স্থাপনার রাউটার ও সুইচ ব্যবহার করে চোরাই পথে দেশের বাইরে থেকে ব্যান্ডউইথ নিয়ে আসছে তারা, যা আইআইজি গাইডলাইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বিটিআরসির অনুমোদন এবং ইনফ্রাস্ট্রকাচার শেয়ারিং চুক্তি না থাকা সত্ত্বেও আইআইজি লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই অবৈধ সুবিধা দিচ্ছে আইটিসি অপারেটররা।

শুধু এই প্রতিষ্ঠানগুলো নয়, অবৈধভাবে ব্যান্ডউইথ আমদানির সঙ্গে জড়িত রয়েছে বেশিরভাগ আইটিসি, আইআইজি, আইএসপি ও এনটিটিএন লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান। অবৈধভাবে আমদানিকৃত ব্যান্ডউইথ আইটিসিগুলোর স্থাপনা থেকে যশোর হাইটেক পার্কে নেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে বিভিন্ন লাইসেন্সধারী অপারেটরের কাছে সরবরাহ করা হয়। অবৈধভাবে ব্যান্ডউইথ আমদানি চক্রের সঙ্গে বিটিআরসির উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

কালবেলার প্রতিবেদনে বলা হয়, বিটিআরসির অভিযানের মাধ্যমে উঠে আসে অবৈধ ব্যান্ডউইথ সরবরাহ চক্রের প্রমাণ, যার পরিপ্রেক্ষিতে আইটিসি অপারেটরগুলোকে বিভিন্ন পরিমাণে জরিমানা করেছে বিটিআরসি। জানা গেছে, গত ২১ এপ্রিল বিটিআরসির কমিশন সভায় আইটিসি লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শনে প্রাপ্ত অনিয়মের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। সেই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বিটিআরসির আইন অমান্য করায় জড়িত আইটিসি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে জরিমানা করা হয়। জরিমানার অর্থ ১০ কার্যদিবসের মধ্যে পরিশোধের জন্য চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

শুধু অবৈধভাবে ব্যান্ডউইথ আমদানি নয়, আইটিসিগুলোর বিরুদ্ধে ক্রয়মূল্য থেকে বিক্রয়মূল্য কম দেখানোর অভিযোগ উঠেছে। ক্রয়মূল্যের থেকে বিক্রয়মূল্য কম নির্ধারণ করে প্রতিযোগিতা আইন-২০১২ এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন-২০০১ লঙ্ঘন করায় আইটিসিগুলোকে ৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

অভিযুক্ত আইটিসি ও আইআইজিগুলো অভিযোগ অস্বীকার করলেও বিটিআরসি বলছে এটা সম্পূর্ণ অবৈধ। প্রতিবেদনে সংস্থাটির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. এমদাদ উল বারী কালবেলাকে বলেন, গাইডলাইন অনুযায়ী কোনো আইআইজি লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যান্ডউইথ আমদানির সুযোগ নেই। শুধু আইটিসি লাইসেন্সধারীরা ব্যান্ডউইথ আমদানি করতে পারবে। যদি তারা বলে থাকে আইআইজি লাইসেন্স দিয়ে ব্যান্ডউইথ আমদানি করা যায়, তাহলে তারা সেটা দেখাক। তিনি বলেন, অভিযানে যেসব ব্যত্যয় পাওয়া গেছে, সেগুলোর ভিত্তিতে জরিমানা করা হয়েছে। প্রথমে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত আইটিসিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, পরবর্তী আইআইজিগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।