Image description

মিয়ানমারের সামরিক জান্তা দেশটির সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি-নিয়ন্ত্রিত রাখাইনে বাংলাদেশ হয়ে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর কোনো ধরনের ব্যবস্থা চায় না। আবার অন্তর্বর্তী সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আগামী সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে যে আন্তর্জাতিক সম্মেলন করতে চায়, তাতেও জান্তার আপত্তি আছে। কূটনৈতিক একটি সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, জান্তার পক্ষ থেকে এ দুটি বিষয়ে আপত্তির কথা অনানুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকারকে জানানো হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কয়েকটি দেশের উৎসাহে জাতিসংঘের উদ্যোগে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠানোর বিষয়ে যে আলাপ-আলোচনা চলছে; এখন মিয়ানমার জান্তার আপত্তির মুখে তা কতটা কার্যকর হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে কূটনীতিকদের।

বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে রাখাইনে যেকোনো ধরনের ‘সহায়তা’ দেওয়া হলে তা আরাকান আর্মিকে সাহায্য করা হিসেবে গণ্য করা হবে— জান্তার এমন অবস্থানের মুখে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ এখনই বিষয়টি নিয়ে এগোনোর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আগামী সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের পাশে বাংলাদেশ যে আন্তর্জাতিক সম্মেলন করতে চায়, তাতে জান্তার আপত্তি কেন—জানতে চাইলে একজন কূটনীতিক জানান, জাতিসংঘে মিয়ানমারের প্রতিনিধিত্ব করছে অং সান সু চির দল এনএলডি নিয়ন্ত্রিত ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) কর্মকর্তা; আপত্তি এ কারণে।

বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে রাখাইনে মানবিক সহায়তা করিডরের বিষয়ে সরকারের ‘নীতিগত সম্মতির’ বিষয়টি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন গত ২৭ এপ্রিল সাংবাদিকদের জানান। এ বিষয়ে কার কার সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার কথা বলেছে, কী কথা হয়েছে, সে বিষয়গুলোও রয়েসয়ে সামনে আনছেন সরকারের উপদেষ্টারা।

এ প্রসঙ্গে সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান গতকাল রোববার বলেন, ‘আমরা মানবিক করিডর নিয়ে কোনো আলোচনা করিনি। এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ নিয়ে কোনো পক্ষের সঙ্গে কোনো সমঝোতাও হয়নি।’

গতকাল ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: আঞ্চলিক নিরাপত্তায় কৌশলগত প্রভাব ও ভবিষ্যৎ পথ’ শীর্ষক এক সেমিনারে এসব কথা বলেন খলিলুর রহমান। সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) যৌথভাবে বিইউপি মিলনায়তনে এ সেমিনারের আয়োজন করে।

বিষয়টি আরেকটু খোলাসা করে খলিলুর রহমান বলেন, রাখাইনের সঙ্গে যে ‘মানবিক করিডরের’ কথা বলা হচ্ছে, তা ‘করিডর’ নয়। তাঁরা রাখাইনে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে একটি ‘চ্যানেলের’ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। করিডর ও চ্যানেল এক নয়। এমন কিছু হলে (চ্যানেল) জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হওয়ার কথা, যার মাধ্যমে ত্রাণ ও খাদ্য যাবে।

খলিলুর রহমান বলেন, ‘মানবিক করিডরের’ নামে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ কোনো ‘প্রক্সি ওয়ারে’ জড়াবে না। এ বিষয়ে যা প্রচার করা হচ্ছে, তা নিছকই অপতথ্য ও গুজব। বাংলাদেশ মিয়ানমারের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, এটা উল্লেখ্য করে তিনি বলেন, দেশটিতে (মিয়ানমার) নতুন করে অস্থিতিশীলতা তৈরি হোক, এমন কিছুই বাংলাদেশ চায় না।

একই সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। সামরিক জান্তা, আরাকান আর্মি ও এনইউজি মিয়ানমারের প্রধান অংশীজন, এমনটা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেকোনো স্থায়ী সমাধানে অবশ্যই এই তিন পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বিশেষ করে আরাকান আর্মিকে, যারা এখন রাখাইন রাজ্যের বিশাল অংশ নিয়ন্ত্রণ করে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় প্রক্রিয়া ‘বৃথা’—এমনটা উল্লেখ করে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, একজন রোহিঙ্গাকেও এখনো প্রত্যাবাসন করা যায়নি। যেকোনো প্রত্যাবাসন অবশ্যই স্বেচ্ছায় হতে হবে। নিরাপত্তা ও পূর্ণ নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা থাকতে হবে। তারা এমন জায়গায় ফিরে যাবে না, যেখানে তাদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ এবং তাদের অস্বীকার করা হয়।

জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ সরকারের তথ্য অনুযায়ী, রাখাইনে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী ও সহযোগীদের দমন-পীড়নের মুখে ১২ থেকে ১৩ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

গতকালের সভায় সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লে. জেনারেল এস এম কামরুল হাসান তাঁর বক্তব্যে রাখাইনে আরাকান আর্মির প্রভাব ও সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমারের সরকারি কর্তৃপক্ষের অনুপস্থিতির জটিলতা তুলে ধরেন।

বক্তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে আঞ্চলিক নিরাপত্তার বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখা, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আরাকান আর্মির অনিশ্চিত অবস্থান এবং ভৌগোলিক রাজনীতির বিভাজনের মধ্যে বাংলাদেশকে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় কূটনীতি, নিরাপত্তা, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সংমিশ্রণে একটি বহুমুখী কৌশল গ্রহণের আহ্বান জানান।

বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সভাপতি এম হুমায়ুন কবির, বিইউপির উপাচার্য মেজর জেনারেল মো. মাহবুব-উল আলম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সাহাব এনাম খান ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষণা পরিচালক আবু সালাহ মো. ইউসুফসহ অন্যরা আলোচনায় অংশ নেন।