
দেশে ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের অধীন মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারি চাকরি করছেন ৮৯ হাজার ২৮৬ জন। তাদের বিষয়ে যাচাই-বাছাই করছে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার যাচাই-বাছাই শেষ হয়েছে। যারা মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি নিয়েছেন প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ে তাদের ৩ থেকে ৪ শতাংশের তথ্যের গরমিল পেয়েছে মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
যাচাই-বাছাই কমিটিতে থাকা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যাদের তথ্যের গরমিল আছে তাদের নামের তালিকা করা হচ্ছে। এই তালিকা নিজ নিজ মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে পাঠানো হবে। তবে এ তালিকা চূড়ান্ত নয়। এখন প্রাথমিক যাচাই-বাছাই চলছে। এতেই ৩ থেকে ৪ শতাংশ চাকরিজীবীর তথ্যের গরমলি পাওয়া গেছে। অধিকতর যাচাই-বাছাইয়ে এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
এর আগে গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেছিলেন, ‘সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কতজনের চাকরি হয়েছে, এর একটি তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ না করে যারা মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তিনি আরও বলেছেন, ‘বিগত আন্দোলনে প্রধান বক্তব্য ছিল মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের কোটা। তাই মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কতজনের চাকরি হয়েছে, সেটার একটি তালিকা প্রস্তুত হওয়ার পর পুরো বিষয়টি নিয়ে আমরা আপনাদের (সাংবাদিক) সামনে উপস্থাপন করব।’
জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি নিয়ে এখন পর্যন্ত যারা যথাযথ প্রমাণাদি জমা দেননি, তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত (এন্ট্রি) করা হচ্ছে। তাদের কাগজপত্র জমা দিতে বলবে মন্ত্রণালয়। এতদিন কেন জমা দেননি তার জবাবও চাওয়া হবে। যারা প্রমাণাদি দিতে ব্যর্থ হবেন তাদের নাম চূড়ান্ত তালিকায় যুক্ত করবে মন্ত্রণালয়। সেইসঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হবে।
কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পাওয়া ৫০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিষয়ে যাচাই-বাছাই শেষ হয়েছে। এই চাকরিজীবীদের মধ্যে ৩ থেকে ৪ শতাংশ তথ্যের গরমিল পেয়েছে মন্ত্রণালয়। গরমিল পাওয়া তথ্যের মধ্যে রয়েছে, তথ্য গোপন করা, নাম-ঠিকানা ভুল দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধা চাচাকে বাবা বানিয়ে কোটায় চাকরি নেওয়া, গেজেট হওয়ার আগেই চাকরি, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকরি, মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর বারবার নির্দেশনা দেওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধার প্রমাণাদি কাগজপত্র জমা না দেওয়া। যাচাই-বাছাই কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের উপসচিবসহ প্রায় ৩০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছেন। যুগ্ম সচিব এস এ এম রফিকুন্নবী এই কমিটির প্রধান।
জানা গেছে, বিগত সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্রায় ৩০ হাজার নিয়োগ পেয়েছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে। সবচেয়ে বেশি নিয়োগ দেওয়া হয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং জননিরাপত্তা বিভাগ ও বাংলাদেশ পুলিশে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে তাদের ছেলেমেয়ে ও নাতি-নাতনিদের সরকারি চাকরির অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে কোটা চালু করে সরকার। এর মধ্যে বিপুলসংখ্যক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে নিয়োগ পাওয়ার অভিযোগ ওঠে। এমন প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসব সনদ যাচাই-বাছাইয়ের উদ্যোগ নেয়। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থার কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়। এরই মধ্যে ৫৮টি মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর এবং এর অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কর্মরতদের তথ্য জমা পড়েছে।
কোন দপ্তর, সংস্থা, মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে কতজন: বর্তমানে ৫৮টি দপ্তর, সংস্থা, মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কর্মরত ৮৯ হাজার ২৮৬ জনের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে ১৬; অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে ১৭; পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগে ১২; যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ১০১; মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ১৩; ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে ১৩২; জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) ১; সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ১০৬; বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে ১৮১; পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ১২; বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন সচিবালয়ে ৭ হাজার ৪০৭; বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে ১৩২; জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ১৭১; সেতু বিভাগে ১২; পরিকল্পনা বিভাগে ২৯; আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে ৪ হাজার ২৮৬; কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে ৫৬; বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনে ৭৯; বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ৩৯; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে ২০৯; জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগে ৭০; মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ৪৫; লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগে ৯; তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগে ২৭; পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে ২২১; পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগে ৬৮১; মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ৩৩০; শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে ১১৫; বিদ্যুৎ বিভাগে ৩৬৬; প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে ১০০; ভূমি মন্ত্রণালয়ে ৭৬; নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে ৯৯৭; তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে ৩০৩; পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে ২৫৭; দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে ৬৮; অর্থ বিভাগে ১৮৯; স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে ২ হাজার ৪৩০; মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে ৩৭, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ১৪; খাদ্য মন্ত্রণালয়ে ১ হাজার ২৫২; শিল্প মন্ত্রণালয়ে ৫৪২; সুরক্ষা সেবা বিভাগে ২ হাজার ১০১; মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগে ১ হাজার ৭৩২; স্থানীয় সরকার বিভাগে ১ হাজার ১৯১; সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে ৪৮৯; সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে ২১৮; অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে ৮১০; গৃহায়ন ও গণপূর্ত বিভাগে ২৬৮; রেলপথ মন্ত্রণালয়ে ১৪; বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে ২২৫; প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে ৮১১; আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ৩২৮; প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ২৯ হাজার ৪৮৫; জননিরাপত্তা বিভাগ ও বাংলাদেশ পুলিশে ২৩ হাজার ৬৩; বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে ৫৬; স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে ৪ হাজার ৮৩৫; পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ৬১৭; কৃষি মন্ত্রণালয়ে ১ হাজার ৮৫২ জন রয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ না করে অনেকে প্রভাব খাটিয়ে ও দুর্নীতির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়েছেন। অনেকে ভুয়া সনদ তৈরি করেছেন। মুক্তিযোদ্ধার বয়স নিয়েও বিভিন্ন সময় নানা প্রশ্ন উঠেছে। চার থেকে পাঁচ বছর বয়সীদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেওয়ার নজির রয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা এবং আগের সব সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা মুক্তিযুদ্ধ না করে ক্ষমতার প্রভাবে তাদের বাবা, চাচা, ভাই ও নিজের নামে সনদ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার অভিযোগ বহু রয়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত বছর জুলাই মাসে আন্দোলনে নামেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গত বছরের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যান। অবসান ঘটে তার নেতৃত্বে টানা ১৫ বছরের দুঃশাসন। পরে ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরু করে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ১৪ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সভায় স্বাধীনতার পর থেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটার আওতায় গ্রেড অনুযায়ী কতজন সরকারি চাকরি পেয়েছেন, সে তালিকা করার নির্দেশ দেন। এরপর ১৫ আগস্ট প্রথম দফায় ‘অনতিবিলম্বে’ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরিরতদের তথ্য চেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে পৃথক চিঠি দেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, যারা মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি নিয়েছেন, এমন কর্মকর্তা-কর্মচারী সংখ্যা ৮৯ হাজার ২৮৬ জন। তাদের বিষয়ে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলমান। প্রায় অর্ধেকের মতো কাজ শেষ হয়েছে। যাচাই-বাছাই করে এন্ট্রি করা হচ্ছে। তবে এটা প্রাথমিক যাচাই-বাছাই, চূড়ান্ত নয়। এরপর অধিকতর যাচাই-বাছাই করা হবে। এক ধরনের গোপনীয়তা রক্ষা করে এই কমিটি কাজ করছে বলেও জানান তিনি।