
মো. আজহার শাহিন। রাজধানীর বনশ্রীর ডি ব্লকে স্ত্রী, এক কন্যা আর দুই ছোট ভাইকে নিয়ে থাকেন দুই কক্ষের ছোট একটি ফ্ল্যাটে। ডাইনিং স্পেস ছোট হলেও কোনো রকমে মানিয়ে নিয়ে বসবাস করছেন। ফ্ল্যাটে একমাত্র কন্যা রুবাইয়া ইসলামের অনেকটাই বন্দি সময় কাটে। আলো-হাওয়ার পরশ মেলে একচিলতে বারান্দায় গেলে। তবে মশার কারণে সেখানেও স্বস্তি নেই। মশার উপদ্রবের কারণে ফ্ল্যাটের জানালা-দরজা বন্ধই রাখতে হয়। বিদ্যুতের খুব একটা সমস্যা না হলেও পানি নিয়ে সংকট আর কাটে না। রান্নার সময় গ্যাস সরবরাহে প্রায় সময়ই সমস্যা দেখা দেয়।
তবে সমস্যা যা-ই থাক না কেন মাস শেষে ১০ তারিখের মধ্যেই ফ্ল্যাটের মালিককে ভাড়া হিসেবে দিতে হয় ১৭ হাজার টাকা। ওই সময়ের মধ্যে অফিস থেকে বেতন না পেলেও ফ্ল্যাটের ভাড়া পরিশোধের সময় বাড়ে না। সময়মতো ভাড়া দিতে না পারলে শুনতে হয় নানা কথা। বেসরকারি একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে কর্মরত আজহার শাহিনের বেতন মাসে ৩০ হাজার টাকা। বেতনের তিন ভাগের দুই ভাগ বাসাভাড়া দিয়ে কোনোমতে সংসার টানতে হাঁপিয়ে ওঠা এই ব্যক্তি বলেন, ‘বেতন পাওয়ার আগেই বাসাভাড়া দিয়ে দেওয়ার হিসাব করা লাগে। যা বেতন পাই তা দিয়ে মাস চালানো মুশকিল। বেতন পাওয়ার ১০ দিনের মধ্যেই টানাটানি লেগে যায়। বাচ্চাটার জন্য আলাদা করে কিছু আনা তো দূরের কথা, সংসারের খরচ চালাতেই হিমশিম খাচ্ছি। এসব কথা কাকে বলব? বলার তো জায়গা নেই।’
রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ভাড়া বাড়িতে থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, এমন অবস্থা শুধু একজন আজহার শাহিনের নয়। ঢাকা শহরে বাসস্থানের সংকট দীর্ঘদিনের, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই সংকট যেন নতুন মাত্রা পেয়েছে। বাড়িভাড়া আকাশচুম্বী হারে বাড়লেও বাড়ছে না বাসার মান বা সুবিধা। ন্যূনতম মানবিক সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই মানুষ থাকতে বাধ্য হচ্ছে গাড়ির গ্যারেজের মতো ফ্ল্যাটে, কনটেইনার বাসা বা সেমিপাকা ঘরে। অভিযোগ উঠেছে, বাড়িওয়ালাদের স্বেচ্ছাচারিতা ও নিয়ন্ত্রণহীন ভাড়া বৃদ্ধিই এই সংকটের মূল কারণ।
পূর্ব রাজাবাজার এলাকার বাসিন্দা নাজমুল হোসেন বলেন, ‘মাত্র তিন বছরের মধ্যে আমার বাসার ভাড়া ১২ হাজার টাকা থেকে ১৮ হাজারে উঠে গেছে। কিন্তু বাসার অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। বারান্দা ভাঙা, পানির লাইন নষ্ট, তবু বাড়িওয়ালা শুনছেন না কিছুই।’
অনেকে অল্প টাকায় থাকার জন্য অনিরাপদভাবে থাকছে। ভাটারা এলাকায় গ্যারেজের মতো একটি রুমে থাকেন গার্মেন্টসকর্মী সালমা বেগম। তিনি বলেন, ‘টিনের ছাউনির একটি রুম, গরমে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তবু এখানে থাকি। কারণ অন্য কোথাও ভাড়া অনেক বেশি।’ উত্তরার একটি নির্মীয়মাণ ভবনের পাশে বসবাস করছে বেশ কয়েকটি পরিবার। এসব পরিবার কনটেইনার বাসায় থাকে। তাদের মতে, চাইলেও ভালো জায়গায় যাওয়া সম্ভব নয়। আট থেকে ১০ হাজার টাকায় কোনো বাসা মেলে না। আর যেখানে মেলে সেখানে পানি, গ্যাস কিছুই ঠিকঠাক মেলে না।
রাজধানীর মিরপুর ১০ এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন বেসরকারি চাকরিজীবী ওয়াসফিয়া আক্তার। তিনি বলেন, ‘আমি একটি কম্পানিতে চাকরি করি, বেতন ৩৫ হাজার টাকা। দুই সন্তান, স্ত্রীসহ দুই রুমের একটি বাসায় থাকছি। ভাড়া বাবদ মাসে ১৮ হাজার টাকা চলে যায়। ১৫ হাজার টাকা ফ্ল্যাটের ভাড়া, সেই সঙ্গে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, ময়লার বিল সব মিলিয়ে আরো তিন হাজার টাকা। তার মানে আমার বেতনের ৩৫ হাজার টাকার মধ্যে ১৮ হাজার বাসাভাড়ায়ই চলে যায়। বেতনের ৫০ শতাংশের বেশি বাসাভাড়া পরিশোধেই চলে যাচ্ছে। এরপর আছে সংসারের খরচ, সন্তানদের স্কুলের খরচ তো আছেই। এতে সংসার চলে টানাটানির মধ্যে।’
রাজধানীর মধ্যমানের আবাসিক এলাকাগুলোর বাড়িভাড়া মধ্যবিত্তের সামর্থ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। মাসে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা আয় করে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা বাড়িভাড়ায়ই চলে যাচ্ছে।
আজিমপুর খান মোহাম্মদ মসজিদসংলগ্ন সাততলা একটি ভবনের মালিক আমিনুল ইসলাম বাবু বলেন, ‘ভাড়াটিয়াদের সব অভিযোগ ঠিক নয়। বছর বছর খরচ বাড়ে। ওয়াসার পানির বিল বেশি দিতে হয়, বিদ্যুৎ বিল বাড়ে, সব মিলিয়ে অল্প পরিমাণ ভাড়া বাড়ানো হয়। কোনো বাড়িওয়ালা যদি অতিরিক্ত ভাড়া বৃদ্ধি করে, তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
তবে রাজধানীর অনেক এলাকায় বাড়ির মালিকরা গ্যাস ও বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করেন না। ভাড়াটিয়াকেই আলাদাভাবে পরিশোধ করতে হয়। সে কারণে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সব এলাকায় বাড়িভাড়া বাড়ানোর সম্পর্ক নেই।
ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ১৫ বছরে বাড়িভাড়া বেড়েছে ৬২৮ শতাংশ। গত ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়িভাড়াসংক্রান্ত জরিপে সংগঠনটি জানিয়েছিল, এ সময় বাড়িভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ এ সময়ে নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার দ্বিগুণ।
সংগঠনটির অন্য এক পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকার ২৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া প্রায় ৫০ শতাংশ, ১২ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ ব্যয় করে বাড়িভাড়া পরিশোধে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খাদ্য নিরাপত্তা পরিসংখ্যান ২০২৩-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সিটি করপোরেশনগুলোতে বসবাসকারীদের মধ্যে ৭২ শতাংশই ভাড়া বাসায় থাকে। সিটি করপোরেশনের বাইরে অন্য শহরে বসবাসকারীদের মধ্যে ভাড়া বাড়িতে থাকে ১৮ শতাংশ। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর সময়ে শহরে বাড়িভাড়া বাড়ে ৫.৮৯ শতাংশ।
বিভিন্ন পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঢাকায় বর্তমানে আড়াই কোটিরও বেশি মানুষের বসবাস। প্রতিবছর রাজধানীতে ছয় লাখ ১২ হাজার মানুষ নতুন করে যুক্ত হচ্ছে। এক দিনের হিসাবে এক হাজার ৭০০ জন। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহরগুলোর তালিকায় ঢাকা অন্যতম। আয়তন ও জনসংখ্যার হিসাবে ঢাকা সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরের একটি। এ শহরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪৩ হাজার ৫০০ মানুষ।
কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভাড়াটিয়াদের বলার কোনো জায়গা নেই। এরা অসহায়। আইনেও কোনো সুরক্ষা নেই। কাউকে গিয়ে যে বলবে সেই সুযোগও নেই। আইন কাগজে থাকলেও বাস্তবে নেই। এই আইনের কোনো অস্তিত্ব নেই। বিধি হয়নি, তাই বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষও নেই। এই আইন ভাড়াটিয়াদের কোনো কাজে আসে না।’
তিনি বলেন, ‘বছর বছর নানা অজুহাতে ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, নতুন বাড়িগুলোতে ভাড়া কত হবে, সেটি ঠিক করছে বাড়িওয়ালা। ইচ্ছামতো ভাড়া ঠিক করে নিয়ে নিচ্ছে। আবার ভাড়াটিয়া পরিবর্তন হলে নতুন ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। আর বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির দাম বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন অজুহাতে বাড়তি টাকা নেওয়া তো আছেই।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে ভাড়ার বিষয়টি নির্ধারণের জন্য চেষ্টা করেছিলাম। অনেকবার তাদের সঙ্গে বসেছি। তারা বলে, আইনে এই ধরনের কোনো সুযোগ নেই যে তারা সমাধান করবে। তাই সেটা হয়নি। হাইকোর্ট থেকে এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলেও সেটিও বাস্তবায়ন করা হয়নি।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মো. জিল্লুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি যোগদান করেছি খুব বেশিদিন হয়নি। এখন পর্যন্ত এলাকাকেন্দ্রিক ভাড়া কেমন হতে পারে, তা নির্ধারণের কোনো নির্দেশনা আছে কি না জানা নেই। এমন নির্দেশনা থাকলে আমরা এ বিষয়ে কাজ করব।’