
দেশে প্রতিবছর বজ্রপাতে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০১১ থেকে চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত ১৫ বছরে বজ্রপাতে তিন হাজার ৮৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। বজ্রপাতে মৃত্যুরোধে এর আগে বেশ কিছু প্রকল্প নেওয়া হলেও আশানুরূপ ফল মেলেনি। এমন পরিস্থিতিতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে আগাম সতর্কতা বা পূর্বাভাস দেওয়া এবং সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে।
বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি ও বিপুলসংখ্যক প্রাণহানি বিবেচনা করে ২০১৬ সালে সরকার একে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর বজ্রপাত থেকে বাঁচাতে গত সরকারের সময় তালগাছ লাগানো, বজ্রনিরোধক ও লাইটনিং অ্যারেস্টার স্থাপনসহ কিছু প্রকল্প নেওয়া হয়। তবে এগুলো শেষ পর্যন্ত বজ্রপাতে হতাহত কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। এর মধ্যে তালগাছ লাগানোর প্রকল্প যে গ্রহণযোগ্য সমাধান ছিল না, তা তখন স্বীকার করেছিলেন তৎকালীন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান।
এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি যখন প্রথম আসি, বজ্রদণ্ডসহ (লাইটনিং অ্যারেস্টার) বেশ কিছু উদ্যোগ ছিল, এখানে যা সফল হয়নি। এগুলো দিয়ে আমাদের দেশে কিছু হবে না। আমরা এখন গুরুত্ব দিচ্ছি আর্লি ওয়ার্নিংয়ে (আগাম সতর্কতায়)। এখন ১০ থেকে ১৫ মিনিট আগে বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব। আর্লি ওয়ার্নিং যদি আমরা যথাযথ সময়ে দিতে পারি এবং এসএমএস বা ফোন কলের মাধ্যমে মানুষকে সতর্ক করে দিতে পারি, তাহলে তা কাজে দেবে বলে মনে করি। সেই নিরিখেই কাজ হচ্ছে এখন।’
ফারুক ই আজম বলেন, ‘আধঘণ্টা আগেও বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব। আধঘণ্টা মানে অনেক সময়। আধঘণ্টা আগে যদি আমরা পূর্বাভাস দিয়ে সতর্ক করতে পারি, তাহলে অনেক জীবন বাঁচানো সম্ভব। এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর প্রথমবারের মতো বজ্রপাতের সতর্কবার্তা জারি করেছে চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল। সেদিন প্রথম সতর্কবার্তায় দেশের ২৭ জেলার জন্য বজ্রপাত ও বজ্রবৃষ্টির সতর্কতা জারি করে অধিদপ্তর। এর পর থেকে নিয়মিত বজ্রপাতের আগাম সতর্কতা ও পূর্বাভাস দিয়ে আসছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
এ বিষয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের উপপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ও আবহাওয়াবিদ এস এম কামরুল হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা কিন্তু বজ্রপাত শনাক্ত করতে পারছি, পূর্বাভাসও দিতে পারছি। কিন্তু বজ্রপাতের তথ্য বা সতর্কতা প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছানোই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ বিষয়ে আমরা ভাবছি। যেসব অঞ্চলে একটা নির্দিষ্ট সময়ে বজ্রপাতের আশঙ্কা রয়েছে বলে বুঝতে পারব, সেসব এলাকার মোবাইল টাওয়ার ব্যবহার করে মেসেজ বা ফোনকলের মাধ্যমে এলাকাবাসীকে সতর্ক করা যেতে পারে।’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ১৪ বছরে বজ্রপাতে শুধু তিন হাজার ৮৪৫ জনের মৃত্যুই হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিবছর গড়ে অন্তত ২৭৪ জন মানুষ মারা গেছে এই দুর্যোগে। অন্যদিকে চলতি বছর এখন পর্যন্ত (গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত) ২২ জনের মৃত্যুর তথ্য কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিবীক্ষণ ও তথ্য ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগের পরিচালক নিতাই চন্দ্র দে সরকার। এ বছর এখন পর্যন্ত বজ্রপাতে আহত হয়েছে সাতজন।
দেশে দুর্যোগ অধিদপ্তর ২০১৯ সাল থেকে বজ্রপাতে আহতের পরিসংখ্যান সংরক্ষণ করছে। অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত বজ্রপাতে আহত হয়েছে ৪২৬ জন। অন্যদিকে দুর্যোগবিষয়ক সংস্থা ডিজাস্টার ফোরাম বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ৩৪ জন বজ্রপাতে মারা গেছেন। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে ছয় জন, মার্চ মাসে দুজন এবং এপ্রিল মাসের প্রথম ২১ দিনে ২৬ জন মারা গেছে। আহত হয়েছে ১৬ জন। মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৭ জনই কৃষক।
বজ্রপাতে মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি রোধে আগাম সতর্কতা ও সচেতনতার ওপর জোর দেওয়ার কথা বলছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমানও। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আবহাওয়া অধিদপ্তর বজ্রপাতের আগাম সতর্কতা নিয়ে কাজ করছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সঙ্গে একত্র হয়ে আমরা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর যদি আর্লি ওয়ার্নিং মেসেজ জনগণের কাছে ঠিকমতো পৌঁছাতে পারি তাহলে অনেক কিছু অ্যাচিভ (অর্জন) করতে পারব।’
রেজওয়ানুর রহমান বলেন, ‘আমাদের মূল ফোকাস এখন সচেতনতা তৈরি। আগাম সতর্কতা প্রদান এরই অংশ। আমাদের এখানে গার্লস গাইড, বয়জ স্কাউট, রেড ক্রস, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কমিটির ৮০ হাজার স্বেচ্ছাসেবীসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রয়েছে। তাদের যখনই আমরা প্রশিক্ষণ দিই, তখনই বজ্রপাতসহ বিভিন্ন দুর্যোগ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার কথা বলি। এগুলো আমরা যত সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারব, তত বজ্রপাত সম্পর্কে তারা অবহিত হবে।’
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, প্রাক-বর্ষাকাল অর্থাৎ, মার্চ থেকে মে মাসে দেশে ৩৮ শতাংশ বজ্রঝড় হয়। বর্ষা অর্থাৎ, জুন থেকে সেপ্টেম্বর এই চার মাসে ৫১ শতাংশ বজ্রঝড় হয়।
এ বিষয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মার্চ থেকে মে মাসে বজ্রঝড়ের হার বর্ষার তুলনায় কম হলেও তা খুব শক্তিশালী হয়। সিলেট, রংপুর, পঞ্চগড়, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বজ্রঝড় সবচেয়ে বেশি হয়।
আগাম সতর্কতা বা পূর্বাভাস পদ্ধতিও ব্যর্থ হবে : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, লেখক ও গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একজন কৃষক কখন মাঠে যায়? যখন তার ফসল বুনতে হয় বা কাটতে হয়। তার একটি সিজন (মৌসুম) আছে। ওই সময়ে তাকে যেতেই হবে, সে যাবেই। আপনি আর্লি ওয়ার্নিং দিলে সে কী করবে? মাঠ থেকে চলে আসবে? আসবে না। সুতরাং এটাও ব্যর্থ হবে। কারণ মানুষ কী চায়, মানুষকে কিভাবে বাঁচানো সম্ভব, তা নিয়ে আমরা ভাবছি না।’
গওহার নঈম বলেন, ‘মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাদের কাছে জানতে চাইতে হবে, যে কিভাবে কী করলে আপনারা বাঁচতে পারবেন। আগে আমাদের মাঠের মধ্যে প্রচুর বাবলা ও খেজুরগাছ ছিল। এই মুহূর্তে আমার মনে হয় গাছ লাগানোই সমাধান।’
বেসরকারি সংগঠন সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম (এসএসটিএএফ) ২০১৯ সাল থেকে বজ্রপাতে হতাহতের পর্যবেক্ষণ এবং এ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে। সংগঠনটির সভাপতি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবিরুল বাশার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বজ্রপাতে বেশি মৃত্যু হয় কৃষকদের। কারণ তাঁরা খোলা মাঠে কাজ করেন এবং খালি পায়ে কাজ করেন। বাংলাদেশের ক্ষেত বা মাঠ বড় গাছপালা থেকে দূরে। গাছ তার জীবন দিয়ে বজ্রপাত থেকে মানুষ ও অন্য প্রাণীর জীবন রক্ষা করে। ফলে এই মুহূর্তে আমাদের করণীয়, দ্রুত বর্ধনশীল গাছের চারা বোনা। তালগাছ কিন্তু খুব দ্রুত বাড়ে না। কিছু গাছ, যেমন কদমগাছ খুব দ্রুত বাড়ে। এই গাছগুলো রোপণ করা যেতে পারে।’