
ছিনতাইকারীদের বেপরোয়া তৎপরতায় ঢাকার সড়কে চলাচল দিন দিন আরও বেশি আতঙ্কের হয়ে যাচ্ছে। একের পর এক চাঞ্চল্যকর ছিনতাইয়ে নগরবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে। ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্যে এখন সন্ধ্যার পর বাসা থেকে বের হতে ভয় পান অনেকে। আর মধ্যরাত ও ভোরবেলা খুব বেশি জরুরি কাজ না থাকলে কেউ বের হন না। ঢাকায় ছিনতাই এতটাই বেড়েছে যা বিগত দিনের তুলনায় বেশি। যদিও ছিনতাইয়ের শিকার অনেকেই মামলা করতে চান না। ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে ছুরিকাঘাতে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর আহত হওয়ার সংখ্যাও অহরহ। বেপরোয়া ছিনতাইকারীরা এখন অনেকটা ভিআইপি স্টাইলে ছিনতাই করছে। তারা প্রাইভেট ও মোটরসাইকেলে করে ঘুরে ঘুরে ছিনতাই করে। চাপাতি, ছুরি ও আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে ছিনতাইয়ের পাশাপাশি প্রাইভেটকারের জানালা থেকে টান দিয়েও ছিনতাই করে। সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে।
শনিবার ভোর পৌনে পাঁচটার দিকে ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী এলাকার গ্রিনল্যান্ড টাওয়ারের সামনে প্রাইভেটকারের জানালা খুলে এক নারীর ভ্যানিটি ব্যাগসহ ওই নারীকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। ওই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। রাস্তার পাশে শাড়ি পরা ওই নারী দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার হাতে ছিল একটি ভ্যানিটি ব্যাগ, পাশে একটি ট্রলি ব্যাগ। গাজীপুরে একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিতে সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। হঠাৎ সাদা রঙের একটি প্রাইভেটকার এসে থামে তার সামনে। ঠিক তখনি সাদা প্রাইভেটকারের জানালা খুলে এক ব্যক্তি ঝাঁপিয়ে পড়ে নারীর ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনিয়ে নিতে। কিন্তু ব্যাগ না ছাড়ায় মুহূর্তেই রাস্তায় পড়ে যান ওই নারী। ব্যাগের সঙ্গে সঙ্গে তাকেও টেনে নিয়ে যেতে থাকে ছিনতাইকারীরা। একপর্যায়ে ছিনতাইকারীদের গাড়ি চলে যায়।
রাস্তায় পড়ে আর্ত চিৎকার করছিলেন ওই নারী। তার চিৎকারে আশপাশে থাকা লোকজন ওই নারীকে উদ্ধারে ছুটে আসেন। ব্যস্ত সড়কে এই ছিনতাইয়ের ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ওই নারী গুরুতর শারীরিক আঘাত পেয়েছেন। তার অবস্থা সংকটমুক্ত হলেও মানসিকভাবে চরম আঘাত পেয়েছেন। রাজধানীর পশ্চিম শেওড়াপাড়ায় ইস্ট-ওয়েস্ট স্কুলের পাশের গলিতে ১৮ই এপ্রিল ভোররাতে চাপাতি ঠেকিয়ে এক তরুণীর কাছ থেকে রুপার চেইন ও ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়েছে ছিনতাইকারীরা। মোটরসাইকেলে করে ওই ছিনতাইকারী ছিনতাই করে চলে যায়। এ ঘটনার ভিডিওচিত্র ছড়ানোর পর পুলিশ তৎপর হয়ে আসামিদের গ্রেপ্তার করে।
পুলিশ সদর দপ্তরের অপরাধ পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৫১টি, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮২ শতাংশ বেশি। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) প্রসিকিউশন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ১লা জানুয়ারি থেকে ৮ই মার্চ পর্যন্ত রাজধানীতে ছিনতাইয়ের (দস্যুতা) ৩২০টি মামলায় ৮৫২ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মার্চ পর্যন্ত আড়াই মাসে রাজধানীতে ছিনতাই, ডাকাতি ও দস্যুতার মামলায় গ্রেপ্তার অন্তত ১৫০ জন জামিন পেয়েছেন।
গত ২১শে এপ্রিল রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় ‘ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে’ মো. আরমান হোসেন (২২) নামের এক তরুণ নিহত হন। পরিবারের দাবি, ছিনতাইয়ে বাধা দেয়ায় তাকে হত্যা করা হয়। আদালত সূত্র জানায়, এর আগে গত আগস্ট থেকে মার্চ পর্যন্ত রাজধানীতে ছিনতাইকারীর হাতে সাতজন খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর আগে ৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে যাত্রাবাড়ী থানার মাতুয়াইল বাজার এলাকায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে কাউসার (২৫) নামে এক যুবক নিহত হন। তিনি একটি মশার কয়েল স্ট্যান্ডের কারখানায় কাজ করতেন।
ছিনতাইয়ের ৪৩২ হটস্পট: একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকায় ছিনতাইয়ের হটস্পটের সংখ্যা ৩৪২টি। এগুলোর মধ্যে তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকায় আছে ১০৮টি স্পট। শেরেবাংলা নগর, তেজগাঁও, শিল্পাঞ্চল এবং হাতিরঝিল থানা এলাকায় ২৫ স্পট। বৃহত্তর মিরপুর এলাকায় রয়েছে ৯৫টি হটস্পট। গুলশান ও উত্তরা বিভাগে আছে ৯৪টি এবং মতিঝিল বিভাগে-৩০, ওয়ারীতে-৩৫, রমনা ও লালবাগ বিভাগে ৪৫টি হটস্পট। এসব স্পটে ছিনতাইয়ে সক্রিয় রয়েছে প্রায় ১২শ’ অপরাধী। এর মধ্যে মতিঝিল বিভাগ ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ২১২ জন, মিরপুর ও তেজগাঁও বিভাগে সক্রিয় ৩৮৬, রমনা ও লালবাগ বিভাগে ২১৭, উত্তরা এবং গুলশান বিভাগে ১৫৪, মোহাম্মদপুর থানার আওতাধীন এলাকায় ২০৫ জন ছিনতাইকারী সক্রিয়ভাবে জড়িত।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) এসএন মো. নজরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, ছিনতাইয়ের ঘটনা খুবই কম। একটা-দু’টা ঘটছে সেগুলো আসামি ধরা পড়ছে। শেওড়াপাড়ার ঘটনায় আসামি গ্রেপ্তার ও মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়েছে। সিদ্ধেশ্বরীর ঘটনায় গাড়ি পাওয়া গেছে। মালিকানা কার নামে সেটি বের করার কাজ চলছে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার ইন্তেখাব চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে এসব ঘটনা বাড়লেও র্যাব আগে থেকেই সতর্ক। র্যাব’র ঢাকার ৫টি ব্যাটালিয়নের টহল টিম সার্বক্ষণিক রাস্তায় থাকে। প্রত্যেকটা ব্যাটালিয়নের অধীনে ৪টা করে টহল টিম শিডিউল করে দায়িত্ব পালন করে। মোহাম্মদপুর, বছিলা, কেরানীগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে ছিনতাইকারীদের হাতেনাতে ধরেছি। তিনি বলেন, আমরা সবসময় ছিনতাইয়ের ঘটনা প্রতিহত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। তবুও কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে। সিদ্ধেশ্বরীর ঘটনায়ও আমরা ছায়া তদন্ত করছি।
সিদ্ধেশ্বরীর ঘটনার সময় ওই ভবনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা বলেন, আমি ঘটনার সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ দেখি এমন ঘটনা। তখন রাস্তাঘাটে তেমন মানুষ ছিল না। তার শুধুমাত্র একটা চিৎকার শুনতে পাই- এসময় আমিও পেছন পেছন ছুটতে থাকি। বেশ কিছুদূরে এভাবে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। পরে আমরা সবাই এগিয়ে যাই। এমন ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। এদের ঠেকাবে কে? কিছুদিন আগে আমার নিজেরই ক্যামেরা নিয়ে গেছে ছিনতাইকারীরা।
ঘটনাস্থলে থাকা সিদ্ধেশ্বরী কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, ঘটনাটি যেভাবে ঘটতে দেখেছি ওই নারী তো মারাও যেতে পারতেন। আমরা কেউ রাস্তায় নিরাপদ না। ভিডিওটি দেখে এখনো ভয় কাটছে না, যেকোনো সময় আমাদের সঙ্গেও এমন ঘটনা ঘটতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কঠোর হতে হবে।