Image description

আমেরিকান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্কলারশিপ পেয়েছিলেন পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রিন্সিপাল জিওলজিস্ট ড. মনিরুজ্জামান সুমন। ছয় মাসের ‘ফুলব্রাইট ভিজিটিং স্কলার প্রোগ্রাম ছিল পরমাণু শক্তির তেজস্ক্রিয়া নিয়ে। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় তার যাওয়ার অনুমতি দেয়নি। শুধু তা-ই নয়, সর্বোচ্চ আদালতের মাধ্যমে তার জিও বাতিল করে মন্ত্রণালয়। একই কায়দায় সাইফুর রহমানের জাপান থেকে পাওয়া মর্যাদাপূর্ণ স্কলারশিপও বন্ধ করে দেয় মন্ত্রণালয়। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত বিজ্ঞানীদের সম্মেলন, কর্মশালায় বিজ্ঞানীদের না পাঠিয়ে পাঠানো হয় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের। প্রশ্ন উঠেছে কেন এমন আচরণ করা হচ্ছে দেশের অত্যন্ত স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন ও তার বিজ্ঞানীদের সাথে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের অত্যন্ত সংবেদনশীল পরমাণু শক্তি কমিশন ও বিজ্ঞানীদের পঙ্গু করে রাখতে সুকৌশলে ষড়যন্ত্র করছে মন্ত্রণালয়ে ঘাপটি মেরে থাকা ফ্যাসিবাদের দোসররা। তারা কোনোভাবেই চাইছেন না দেশের বিজ্ঞানীরা আরো জ্ঞান অর্জন করে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রবেশ করুক। তাহলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে শেখ হাসিনা সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি প্রকাশ পেয়ে যাবে।

তারা বলেন, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন। অথচ মালিককে বাদ দিয়ে রাশিয়ান বিজ্ঞানীদের সাথে ভারতীয়দের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। চুক্তি করা হচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে, যা বড় ধরনের ঝামেলার ইঙ্গিত বহন করে। এই ঝামেলা কাউকে বুঝতে না দিতেই কাজ করে যাচ্ছে মন্ত্রণালয়ের দোসররা, যার কারণে কৌশলে এই সেক্টরকে শেষ করতে নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তা না হলে একটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরের বিজ্ঞ বিজ্ঞানীসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন আটকে রাখার মতো অসম্মানজনক কাজ করা হতো না। বিজ্ঞানীদের সেমিনার ওয়ার্কশপে তাদের না পাঠিয়ে সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের পাঠানো হতো না। এর পেছনে গভীর কোনো ষড়যন্ত্র কাজ করছে।

সূত্র মতে, সম্প্রতি আমেরিকা, অস্ট্রিয়া, কোরিয়াসহ কয়েকটি দেশে বিজ্ঞানীদের ১৪টি সম্মেলন ও কর্মশালায় অংশগ্রহণের জন্য ১৪ জনকে মনোনীত করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, যার মধ্যে একজন বিজ্ঞানীর নামও নেই। তাদের সবাই মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পদ মর্যাদার কর্মকর্তা।

সূত্রে জানা গেছে, আমেরিকায় অনুষ্ঠিত নিউক্লিয়ার সিকিউরিটির ওপর একটি ইন্টারন্যাশনাল ট্রেনিং কোর্সে কোনো বিজ্ঞানীকে না পাঠিয়ে পাঠানো হয় মন্ত্রণালয়ের অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি মো: মইনুল ইসলাম তিতাসকে। ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক ফর নিউক্লিয়ার সিকিউরিটির ওপর ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত প্রোগ্রামে পাঠানো হয়েছে ডেপুটি সেক্রেটারি মোহাম্মদ আশরাফুল আফসারকে। অস্ট্রিয়ায় ইনসাইডার থ্রেট ইউজিং দি শাপারস থ্রিডি মডেলের ওপর কর্মশালায় পাঠানো হয় সিনিয়র অ্যাসিসটেন্ট সেক্রেটারি ফারজানাকে। সিডনিতে অনুষ্ঠিত সেইফ ট্রান্সপোর্ট অব রেডিওকেটিভ মেটেরিয়াল প্রোগ্রামে সিনিয়র অ্যাসিসটেন্ট সেক্রেটারি মো: সানোয়ার হোসেনকে পাঠানো হয়। একইভাবে বিজ্ঞানীদের ১৪টি কর্মশালায় পাঠানোর জন্য মনোনীত করা হয় সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের। কিন্তু কেন? বিজ্ঞানীদের প্রশ্ন তাহলে কি কারো স্বার্থরক্ষায় বাংলাদেশের পরমাণু শক্তি কমিশনকে ধ্বংস করা হচ্ছে। তারা বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে পরমাণু শক্তি কমিশনকে ঢেলে সাজিয়ে আরো শক্তিশালী করা হচ্ছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে এই কমিশনে বাংলাদেশী টাকার এক হাজার এক শ’ কোটি টাকা বাজেট। ভারতে ৩৫ হাজার কোটি টাকা বাজেট রয়েছে। সেখানে আমাদের দেশে বাজেট রয়েছে ৩৬০ কোটি টাকা, যার মধ্যে ২৮০ কোটি টাকা সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হয়। বাকি ৮০ কোটি টাকা কমিশনের নিজস্ব আয় থেকে বহন করা হয়। গত দুই মাস সরকারের দেয়া সেই টাকার অংশও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, যার কারণে আটকে গেছে ৬০০ বিজ্ঞানীসহ ২৫০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন। বিজ্ঞানীদের সাথে এমন আচরণ গত ৫০ বছরেও ঘটেনি। ভুক্তভোগীরা বলছেন, সরকারের যদি এই ভাগ না রাখতে ইচ্ছে করে তাহলে, আইনগতভাবে বন্ধ করে দিক। কিন্তু বিজ্ঞানী-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এভাবে অপমান করা ঠিক নয়। এতে দেশের বাইরে রাষ্ট্রেও বিরূপ প্রভাব পড়ে।

ভুক্তভোগী মনিরুজ্জামান জানান, অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে আমেরিকার একটি সম্মানজনক স্কলারশিপের জিও আটকাতে মন্ত্রণালয় সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গিয়েছে। এতেই প্রমাণিত হয় যে, মন্ত্রণালয়ে ঘাপটি মেরে থাকা ফ্যাসিবাদীরা ইচ্ছাকৃতভাবে পরমাণু শক্তি কমিশন ও বিজ্ঞানীদের পঙ্গু করে রাখার ষড়যন্ত্র করছে। তিনি বলেন, আমেরিকায় আমার স্কলারশিপের খবর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদকে জানানো হলে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়ে জিও দেয়ার নির্দেশনা দেন। অথচ বিজ্ঞান প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সেটি আটকে দেয়। এ ব্যাপারে আরো দুইজন উপদেষ্টা সচিবকে ফোন করেছিলেন। কিন্তু তাদের কথা রাখা হয়নি। মনিরুজ্জামান বলেন, এ ধরনের ঘটনা শুধু আমার সাথেই ঘটেছে তা নয়, সাইফুর রহমানের জাপানের স্কলারশিপও আটকে দেয়া হয়।

তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় অভিযোগ করেছে, আমরা বিদেশ গিয়ে আর ফিরে আসব না। অথচ এই স্কলারশিপ এতটা সম্মানীয় যে এই স্কলারশিপে অংশ নিয়ে চোরের মতো সে দেশে থেকে যাওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না। ভুক্তিভোগীরা বলছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারকে পরমাণু শক্তি কমিশন নিয়ে ভাবতে হবে। তা না হলে ফ্যাসিবাদীরা এই কমিশনকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি বিজ্ঞানী সঙ্ঘের সভাপতি ড. এ এস এম সাইফুল্লাহ নয়া দিগন্তকে বলেন, এটি সরকার তথা দেশের একটি সংবেদনশীল সেক্টর। এখানে কাজ করা বিজ্ঞানী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সম্মান নিয়ে কাজ করে থাকেন। দাবি আদায়ের জন্য তাদের নিয়ে আমরা রাস্তায় নামতে পারব না। তবে শিগগিরই নিয়ম মেনে প্রধান উপদেষ্টার কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করব।

এ ব্যাপারে জানতে মোবাইলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিবের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।