Image description
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড

দুই সহোদর আতাউর রহমান (সোহেল) ও মোহাম্মদ জিয়া। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) চট্টগ্রামের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ডিভিশন আগ্রাবাদ, হালিশহর ও নিউমুরিংয়ের সব ধরনের কাজ পেত তাদের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স সোহেল ইনকরপোরেশন’ ও ‘টিডি ট্রেডিং’। এ ছাড়া ঢাকার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘পিএসডিসি-উসাকা জেআর’ কমিশনের বিনিময়ে প্রভাবশালী এই দুই ঠিকাদারের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ আদায় করে নিত। অভিযোগ রয়েছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছর তাদের দাপটে অন্য ঠিকাদাররা বিপিডিবিতে ঘেঁষতেই পারতেন না। আরও অভিযোগ, মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে এই দুই প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতেন বিপিডিবির তিনজন নির্বাহী প্রকৌশলী। দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে বিপিডিবি ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দেওয়া অভিযোগ, কালবেলার অনুসন্ধান এবং কয়েকজন ঠিকাদারের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

গত বছর আগ্রাবাদ, হালিশহর ও নিউমুরিং ডিভিশনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজের দরপত্র ডেকেছিল বিপিডিবি। এর মধ্যে আগ্রাবাদ, হালিশহরের কাজ দেওয়া হয় ‘পিএসডিসি-উসাকা জেআর’কে। আর নিউমুরিং ডিভিশনের কাজ পায় ‘মেসার্স সোহেল ইনকরপোরেশন’।

আগ্রাবাদ ও হালিশহর ডিভিশনের দুই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ কোটি ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তবে নিউমুরিং ডিভিশনের প্রকল্পের ব্যয় কত ধরা হয়েছে তার কাগজ হাতে না আসায় জানা সম্ভব হয়নি।

কালবেলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, আগ্রাবাদ ডিভিশনের ডিপোজিট কাজের দরপত্র আহ্বান করা হয় ২০২৪ সালের ১১ নভেম্বর। দরপত্র প্রস্তাবের জন্য শেষ সময় দেওয়া হয় একই বছরের ২২ ডিসেম্বর। দরপত্রের মেয়াদ ছিল চলতি বছরের ২৯ মার্চ পর্যন্ত। দরপত্র আহ্বানের পর এই প্রকল্পের জন্য আবেদন করে চারটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে তিন প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবনা একই ধরনের হওয়ায় তাদের এক নম্বর তালিকায় রাখা হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে ‘ফেনি অ্যান্ড ডায়নামিক জেভি’, ‘পিএসডিসি-উসাকা জেআর’ ও ‘দ্য ইস্টওয়ে ইলেকট্রিক কোম্পানি’। আর দুই নম্বর তালিকায় ছিল মোহাম্মদ জিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টিডি ট্রেডিং। নিয়ম অনুযায়ী এক নম্বর তালিকার প্রথম দিকে যে প্রতিষ্ঠান সেই ‘ফেনি অ্যান্ড ডায়নামিক জেভি’ কাজটি পাওয়ার কথা। কিন্তু কাজটি পেয়েছে এক নম্বর তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ‘পিএসডিসি-উসাকা জেআর’। অথচ এ প্রতিষ্ঠানটি যাদের সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে কাজ করে, সেই ‘আমেরাহ করপোরেশন (এসি)’ কালো তালিকাভুক্ত।

এ ছাড়া পিএসডিসি-উসাকা জেআরের দরপত্র আবেদনের সময় তাদের বহু কাগজ ছিল ভুলে ভরা। তারা যেই ফিন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট দিয়েছিল সেখানে টেন্ডার আইডি, প্যাকেজ নম্বর উল্লেখ ছিল না। তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আমেরাহ করপোরেশনও দুটি অন্য কোম্পানির ভুয়া সার্টিফিকেট দেয়। স্বাভাবিকভাবে পিপিআর অনুযায়ী, ভুয়া ডকুমেন্টস দিলে এই আবেদন বাতিল হওয়ার কথা। তার পরও প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির অডিট অনলাইন করা নেই। এর বাইরে ‘ক্যাবল ট্রিন্সের’ কাজ পর্যাপ্ত পরিমাণ নেই। তাদের বিওকিউর শর্ত মোতাবেক ‘ক্যাবল ট্রিন্সের’ কাজ তেমন নেই। অন্যদিকে আমেরাহ করপোরেশন ইজিপিতে ব্লক লিস্টেট (কালো তালিকাভুক্ত) কোম্পানি। ফলে প্রতিষ্ঠানটিকে এনওএ কিংবা ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া যায় না। কারণ প্রতিষ্ঠানটি অযোগ্য। এ ছাড়া পিএসডিসি-উসাকা জেআরের অডিটের সঙ্গে টার্নওভারের কোনো মিল নেই।

একইভাবে হালিশহর ডিভিশনের ডিপোজিট কাজের দরপত্র ডাকা হয় ২০২৪ সালের ১১ নভেম্বর। দরপত্র বা প্রস্তাবের মেয়াদ ছিল চলতি বছরের ২২ মার্চ পর্যন্ত। চার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নেয়। ষেখানে বিপিডিবি তালিকার এক নম্বরে রাখে দ্য ইস্টওয়ে ইলেকট্রিক কোম্পানিকে। দুই নম্বরে রাখা হয় পিএসডিসি-উসাকা জেআরকে। তিন নম্বরে আতাউর রহমানের প্রতিষ্ঠান মেসার্স সোহেল ইন করপোরেশন এবং চার নম্বরে রাখা হয় ফেনি অ্যান্ড ডায়নামিক জেভিকে। তবে সব যোগ্য আবেদনকারীকে রেখে এই প্রকল্পের কাজও দেওয়া হয় দুই নম্বরে থাকা পিএসডিসি-উসাকা জেআরকে।

কালবেলার হাতে আসা কিছু ডকুমেন্টস বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দুই নম্বর অবস্থানে থেকেও কাজ পেয়ে যাওয়া সেই পিএসডিসি-উসাকা জেআর প্রতিষ্ঠানের করা আবেদনে রয়েছে বহু সমস্যা। আবেদনে তারা যে স্টেটমেন্ট দিয়েছে, তাতে তাদের টেন্ডার আইডি, প্যাকেজ নম্বর উল্লেখ ছিল না। অডিট রিপোর্ট জমা দিলেও তা অনলাইনে ওপেন করা নেই। ঠিক নেই তাদের সিমিলার ওয়ার্কও। বিওকিউর সঙ্গে মিল নেই কোনো কিছুই।

একইভাবে নিউমুরিং ডিভিশনের প্রকল্পে কাজ দেওয়া হয় তিন নম্বরে থাকা মেসার্স সোহেল ইন করপোরেশনকে।

অভিযোগ রয়েছে, দুই ভাই আতাউর রহমান ও মোহাম্মদ জিয়া আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। গত ১৬ বছর এ দুজনের হাতে একক নিয়ন্ত্রণে ছিল বিপিডিবির বেশিরভাগ কাজ। তারাই সব প্রকল্পে দরপত্র করতেন, প্রভাব খাটিয়ে এসব প্রকল্প বাগিয়ে নিতেন। তাদের সিন্ডিকেটেরই আরেক প্রতিষ্ঠান পিএসডিসি-উসাকা জেআর। যার মালিক ঢাকার গিয়াস উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি। চট্টগ্রামে এই প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ সোহেল ও জিয়ার হাতেই। তারাই সব জায়গায় দরপত্রে অংশ নিতেন। সাধারণ ঠিকাদারদের কাউকে তারা ফরম কেনারও সুযোগ দিতেন না। দুই ভাই সিন্ডিকেট করে কোনো প্রকল্পের দাম কমিয়ে লিখতেন, কোনোটির বাড়িয়ে লিখতেন। কাজ যে প্রতিষ্ঠানই পাক না কেন, নিয়ন্ত্রণ থাকত দুই ভাইয়ের হাতেই।

দুই ভাইয়ের নেপথ্য শক্তি তিন নির্বাহী পরিচালক!: অভিযোগ রয়েছে, দুই ভাইয়ের ঠিকাদার সিন্ডিকেটের নেপথ্য শক্তি চট্টগ্রাম বিপিডিবির তিন নির্বাহী প্রকৌশলী। তাদের একজন তৌহিদুল ইসলাম। তিনি হালিশহর ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী। বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। সেই সুবাদে ক্ষমতার অপব্যবহার করে আওয়ামীপন্থি ঠিকাদারদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তাদের বিশেষ সুবিধা দিতেন। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি। কালবেলাকে তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষাজীবন থেকে শুরু করে চাকরি, কখনোই আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমার সম্পৃক্ততা কখনোই ছিল না। আর টেন্ডারের পুরো প্রক্রিয়াই সরকারি নিয়ম অনুযায়ী হয়ে থাকে। এখানে কারও সঙ্গে আমাদের সিন্ডিকেট করার সুযোগ নেই। কিছু ঠিকার অভিযোগ দিয়েছেন। এ বিষয়ে এরই মধ্যে একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেই কমিটিতে রয়েছেন।’

একই অভিযোগ আগ্রাবাদ ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী ছিংলা মারমার বিরুদ্ধে। তিনিও সব অভিযোগ অস্বীকার করে কালবেলাকে বলেন, ‘আমি কখনোই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। এসব অভিযোগ মনগড়া, ভিত্তিহীন। মূলত যারা কাজ পাননি তারা বিষয়টিকে বিতর্কিত করার জন্য এমন অভিযোগ করেছেন।’

আর নিউমুরিং ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী সামির আসহাব বলেন, ‘ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের সখ্যের কোনো সুযোগই নেই। যত টেন্ডার হয়, সবকিছুই বাস্তবতা ও সরকারি নিয়মের নিরিখে হয়। যারা কাজ পান না তারা হয়তো ক্ষোভ থেকে এসব অভিযোগ করেছেন।’

যা বললেন তিন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক: অভিযোগের বিষয়ে কথা হয় মেসার্স সোহেল ইন করপোরেশনের মালিক মো. আতাউর রহমানের সঙ্গে। কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘মানুষ চাইলে অনেক কথাই বলতে পারে। ই-টেন্ডার পদ্ধতিতে আমাদের টেন্ডার কাজ সম্পন্ন হয়। এসব অভিযোগের কোনো বাস্তবতা নেই, কোনো সত্যতাও নেই। আমাদের বিরক্ত করার জন্যই এমন অভিযোগ তোলা হয়েছে। আমরা সিন্ডিকেট করে কাজ করছি, এমন কোনো নজির নেই। এ ছাড়া আমাকে আওয়ামী লীগপন্থি বলে যে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, তারও বিরোধিতা করি। রাজনীতির সঙ্গে আমার কখনোই সম্পৃক্ততা ছিল না।’

টিডি ট্রেডিংয়ের মালিক জিয়াউর রহমানও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘গত চার বছরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কোনো কাজই আমি করিনি। আমরা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এমন তথ্য কেউ দিতে পারবে না। ব্যবসাতেই আমাদের সার্বক্ষণিক সময় দিতে হয়, রাজনীতি করার সুযোগ কই। কিছু ঠিকাদার কাজ না পেয়ে অনেক কথাই বানিয়ে বানিয়ে বলছেন। এসব অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই।’

সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পিএসডিসি-উসাকা জেআরের পরিচালক ইস্তেফাক আহমেদ। কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘গত ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত ঢাকাসহ সারা দেশে আমার প্রতিষ্ঠান ঠিকাদারি কাজ করছে। এই সময় পর্যন্ত আমরা কাজ নেওয়া কিংবা করার ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক নেতাকে ব্যবহার করিনি। শুরুতে যখন বিদ্যুৎ খাতে মাত্র এক থেকে দুটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করে, তখন থেকেই আমরা কাজ করি। কেউ যদি প্রমাণ দিতে পারে আমরা টেন্ডার বিট করার সময় ভুল তথ্য দিয়েছি, আমি চ্যালেঞ্জ করেই বলছি, আমার প্রতিষ্ঠানের মালিকানা তাকে দিয়ে দেব।’