Image description
ব্যাংক খাত

দেশের ব্যাংক খাতে একসময় সবচেয়ে দ্রুত অগ্রসর হয়ে আর্থিক ভিত্তি স্থাপন করেছিল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ। মানুষের আস্থার প্রতীক হিসেবে আমানত সংগ্রহ থেকে শুরু করে রেমিট্যান্স সংগ্রহ, সব জায়গায় দক্ষতার পরিচয় দেয় ব্যাংকটি। কিন্তু ২০১৭ সালে জোরপূর্বক দখলের পর থেকে দুর্নীতি, অনিয়ম আর ঋণ কেলেঙ্কারি পিছু ছাড়ছে না ব্যাংকটির। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে রদবদল হলেও সেই উল্টোরথেই চলছে ইসলামী ব্যাংক। এতে ব্যাংকটির সব সূচকেই ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকের বর্তমান পর্ষদের চেয়ারম্যান ও সদ্য সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মিলে একাধিক দুর্বল প্রতিষ্ঠানকে বড় ঋণ দেওয়ার চেষ্টা করেন। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে ওইসব ঋণ এখনো ছাড় হয়নি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর নতুন গভর্নরের দায়িত্ব নেন ড. আহসান এইচ মনসুর। দায়িত্ব নিয়েই গত বছরের ২২ আগস্ট ব্যাংকটির পর্ষদ ভেঙে সাবেক ব্যাংকার ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদকে চেয়ারম্যান করে নতুন পর্ষদ গঠন করেন। কিন্তু তিনি দায়িত্ব নিয়ে এখন পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের তেমন কোনো উন্নতি করতে পারেননি। উল্টো ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ অডিটে যেসব কর্মকর্তা দোষী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে, তাদের বাঁচাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে একাধিকবার ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ অডিটের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলেও সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অবহিত করা হয়নি। যদিও চাপের মুখে চলতি মাসের শুরুতে ব্যাংকের সাবেক এমডি মুনিরুল মাওলাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়েছে পর্ষদ।

আর্থিক সূচকের বর্তমান অবস্থা: বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সরকার পরিবর্তনের আগে ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৭ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ খেলাপি বেড়েছে ২৫ হাজার ৯৩ কোটি টাকা। মার্চ প্রান্তিকে এই খেলাপি আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা।

একইভাবে সরকার পরিবর্তনের আগে ইসলামী ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ছিল না। কিন্তু গত ডিসেম্বর শেষে প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। আইন অনুযায়ী প্রভিশন সংরক্ষণ করতে না পারায় ব্যাংকটি এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডেফারেল (অতিরিক্ত সময়) সুবিধা চাচ্ছে। গভর্নর বিদেশ সফর থেকে আসার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানা গেছে। এরপর ব্যাংকটির বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হতে পারে।

ইসলামী ব্যাংক দীর্ঘদিন থেকেই লাভে ছিল। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকেই ব্যাংকটি লোকসান গুনে ৮৯ কোটি টাকা। ডিসেম্বর প্রান্তিকে এখনো হিসাব শেষ করেনি ব্যাংকটি। তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিক, অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ৮৯ কোটি ২০ লাখ টাকা লোকসান করেছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ। আগের বছরের একই সময়ে ব্যাংকটি মুনাফা করেছিল ৯৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে জানা গেছে, জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৫৫ পয়সা। অথচ আগের বছরের একই সময়ে ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি লাভ হয়েছিল ৫৯ পয়সা। ব্যাংকটি লোকসানের কারণ হিসেবে বিনিয়োগের বিপরীতে উচ্চ প্রভিশনকে দায়ী করা হচ্ছে। তবে গত বছরের ৯ মাসে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকটির মোট ২৬৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা মুনাফা হয়েছে।

এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংকের নগদ প্রবাহ উল্লেখযোগ্য বেড়েছে। জানুয়ারি-সেপ্টেম্বরে শেয়ারপ্রতি সমন্বিত নগদ প্রবাহ হয়েছে ঋণাত্মক (নেগেটিভ) ৩ টাকা ২ পয়সা। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ৪৮ টাকা ৯ পয়সা। তৃতীয় প্রান্তিকে লোকসান হলেও ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের নগদ ও নগদ সমতুল্য সম্পদ আছে ১২ হাজার ৩৫৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

এদিকে, ইসলামী ব্যাংক প্রথমবারের মতো মূলধন ঘাটতিতে পড়ার আশঙ্কা করছেন ব্যাংকটির শীর্ষ কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, চট্টগ্রামভিত্তিক বিতর্কিত একটি শিল্পগ্রুপ ইসলামী ব্যাংকে ব্যাপক অনিয়ম ও ঋণ কেলেঙ্কারি করেছে। এজন্যই প্রথমবারের মতো মূলধন ঘাটতিতে পড়তে হতে পারে ব্যাংকটিকে।

নতুন পর্ষদের যত অনিয়ম: গত বছরের ১৯ আগস্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি চিঠির মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংককে ৫ কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণে নিষেধাজ্ঞা দেয়। ৫ কোটি টাকার বেশি বিতরণ করতে হলে এর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অনুমতি নিতে বলা হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা আমলে না নিয়ে থার্মেক্স গ্রুপের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের নামে ৩৭৪ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করেছে ইসলামী ব্যাংক। চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ইসলামী ব্যাংকের ৩৫১তম পর্ষদ সভায় এই ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়। যদিও গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে ঋণ বিতরণে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। থার্মেক্স গ্রুপের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে সিস্টার ডেনিম কম্পোজিট, থার্মেক্স ব্লেন্ডেড ইয়ার্ন, থার্মেক্স কালার কটন, থার্মেক্স নিট ইয়ার্ন ও ইন্ডিগো স্পিনিং লিমিটেড।

এ বিষয়ে কথা বললে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করেছে। ৫ কোটি টাকার বেশি লোন দেওয়া তাদের জন্য নিষেধ। আর দিতে হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্বানুমতি লাগবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি ছাড়াই ইসলামী ব্যাংক তাদের পর্ষদ সভায় এই লোন অনুমোদন দিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত এমডি ওমর ফারুক বলেন, ‘এই ঋণটি আমার দায়িত্ব নেওয়ার আগের। এখনো ঋণের অর্থ ছাড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশনা দেয়নি।’

রপ্তানি অর্থ দিতে গড়িমসি: অনিয়ম-জালিয়াতির মাধ্যমে সব টাকা এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে এখন অন্য গ্রাহকদের রপ্তানি বিল দিতে পারছে না ইসলামী ব্যাংক। আহমেদ গ্রুপের চারটি প্রতিষ্ঠানের ৩৪ লাখ ৭২ হাজার ডলার রপ্তানি বিল পড়ে আছে। বিলগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ (ওভারডিউ) হওয়ার পরও পরিশোধ করতে গড়িমসি করছে ইসলামী ব্যাংক। বিল আদায়ে ব্যর্থ হয়ে আহমেদ গ্রুপের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু বিপরীতে এস আলমের একটি প্রতিষ্ঠানের ৩ লাখ ৭৩ হাজার ডলারের এলসির দায় পরিশোধে তৎপর দেখা যাচ্ছে ইসলামী ব্যাংককে। এ লক্ষ্যে ইসলামী ব্যাংক নাছিরাবাদ শাখা থেকে অনুমিত প্রদানের জন্য প্রধান কার্যালয়ে একটি চিঠিও দেওয়া হয়েছে।

আহমেদ গ্রুপের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে করা অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ইশরাক স্পিনিং মিলের ২২টি বিলে মোট ৭ লাখ ৫৪ হাজার ৭৮৬ ডলার, ইশরাক কটন মিলের রপ্তানি বিল ১৫ লাখ ৯৭ হাজার ৭০২ ডলার, ইশরাক রোটোর স্পিনিং মিলের ১ লাখ ৩৫ হাজার ডলার এবং ইশরাক টেক্সটাইল মিলের মোট রপ্তানি বিল ৯ লাখ ৮১ হাজার ৮৫৭ ডলার আটকে আছে।

অন্যদিকে, এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইউনিটেক্স কম্পোজিট মিলস লিমিটেডের এলসির দায় বাবদ ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৬৮৮ ডলার পরিশোধে বেশ তৎপর ইসলামী ব্যাংক। এলসির দায় পরিশোধের অনুমতি চেয়ে গত ২১ জানুয়ারি ইসলামী ব্যাংক নাছিরাবাদ শাখা থেকে প্রধান কার্যালয়ের স্পেশাল ইনভেস্টমেন্ট উইংয়ে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠি সূত্রে জানা গেছে, ইউনিটেক্স কম্পোজিট মিলের ৬টি এলসি বাবদ বিদেশি কয়েকটি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৬৮৮ মার্কিন ডলার পাবে। সব বিলই ২০২৪ সালের বিভিন্ন সময়ে ওভারডিউ হয়ে গেছে।