Image description

চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার যুবদলকর্মী মানিক আবদুল্লাহ ১৯ এপ্রিল রাতে বাসায় ভাত খাচ্ছিলেন। বাসার ভেতর ঢুকেই অস্ত্রধারীরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। মানিকের পরিবার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, নিজ দলের প্রতিপক্ষ তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এর আগে গত ১০ মার্চ সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলায় কয়লা-পাথর পরিবহনের ট্রাক-লরিতে চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে নিহত হন এক ব্যক্তি।

শুধু এই দুটি স্থানেই নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় দলীয় অন্তর্কোন্দলের জেরে রাজনীতির মাঠে ঝরছে রক্ত, প্রাণ হারাচ্ছেন দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ লোকজন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন খবরের বিশ্লেষণ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্যে বেরিয়ে এসেছে এমন চিত্র। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই (জানুয়ারি থেকে মার্চ) অন্তত ১৭৫টি রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। এসব সংঘাতে নিহত হয়েছেন অন্তত ৩৬ জন এবং আহত হয়েছেন ১ হাজার ৮৩৩ জন।

সংঘটিত সংঘাত ও প্রাণহানির ঘটনাগুলোয় দায়ের করা মামলার তথ্য বিশ্লেষণ, নিহতের স্বজনদের ভাষ্য, পুলিশ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষ্য থেকে বেরিয়ে এসেছে অন্তর্কোন্দলের ঘটনাগুলোর নেপথ্যে রাজনৈতিক আধিপত্য, এলাকাভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ, দুই নেতার অনুসারীদের দ্বন্দ্ব, চাঁদাবাজি ও প্রতিষ্ঠান দখলের মতো ঘটনাগুলো।

মানবাধিকার সংগঠন আসকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলোয় অন্তর্কোন্দলের কারণে সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে ১৩৬টি। এতে নিজ নিজ দলের অন্তত ২৯ জন নেতাকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। একক রাজনৈতিক দল হিসেবে সারা দেশে এ সময়ে ৮৫ বার আত্মঘাতী সংঘাতে জড়িয়েছে বিএনপি। এতে দলটির অন্তত ১৫ নেতাকর্মী ও সমর্থক প্রাণ হারিয়েছেন। এ ছাড়া যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও শ্রমিক দল নিজেদের মধ্যে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে অন্তত ৪০ বার। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ১১ জন।

গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা দেশ-বিদেশে পলাতক থাকলেও দলটির নেতাকর্মীরা গত তিন মাসে অন্তত তিনবার সংঘাতে জড়িয়েছেন। এসব সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন দুজন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘাত হয়েছে একবার এবং এতে একজন প্রাণ হারান। যদিও একই সময়ে অন্তত পাঁচবার অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে সংঘাতে জড়িয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। এতে নিহতের ঘটনা না থাকলেও আহত হয়েছেন ২০ জন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাকর্মীদের মধ্যেও অন্তত দুবার সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহতের ঘটনা না থাকলেও আহত হয়েছেন অন্তত ১৯ জন।

আসকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত মার্চ মাসেই সারা দেশে অন্তত ৭১টি রাজনৈতিক সংঘাত হয়। এতে নিহত হন ২০ জন। এর মধ্যে দলীয় কোন্দলে নিহত ১৮ জন। এর আগের মাসে ৪৬ সংঘাতে ৮ জন নিহত হন। এই ৮ জনের ৬ জনই দলীয় কোন্দলের জেরে খুন হন। জানুয়ারি মাসে রাজনৈতিক সংঘাত হয়েছিল ৫৮টি। এতে ৮ প্রাণহানির মধ্যে ৫ জনই দলীয় কোন্দলের বলি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে রয়েছে দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি। দলটি আওয়ামী লীগের শাসনামলে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও চালাতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের পতনে দীর্ঘদিনের বঞ্চনার পর দলটি স্বাভাবিক রাজনীতিতে ফিরে আসে। এতে দেশের কোনো কোনো এলাকায় নিজেদের মধ্যে নানা স্বার্থের সংঘাত দেখা দেয়। যদিও দলটির হাইকমান্ড এসব সংঘাত-সহিংসতা ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বহিষ্কার, সাময়িক বহিষ্কারসহ নানা ধরনের সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছে।

সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, রাজনৈতিক দলগুলোয় অন্তর্কোন্দলের ঘটনাও তত বাড়বে। বিশেষত দল হিসেবে বিএনপি এসব ঘটনার মুখোমুখি হবে বেশি। কারণ দেশের সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অন্যতম বড় ও শক্তিশালী দল বিএনপি। তাই দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে রাজনৈতিক আধিপত্য, এলাকাভিত্তিক দখল, প্রতিষ্ঠান দখল ও চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে বিএনপির নানা স্তরের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, বিএনপিতে এ ধরনের সংঘাত আরও বাড়াবে। কারণ দখল, চাঁদাবাজির সঙ্গে তখন যুক্ত হবে দলীয় মনোনয়নের বিষয়টি।

সংঘাতের কারণে নানা সময়ে ব্যবস্থা নেওয়ার পরও বিএনপির পক্ষ থেকে অন্তর্কোন্দলের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থার পরিসংখ্যান ও গণমাধ্যমে আসা তথ্যের বরাতে এ ধরনের অন্তর্কোন্দলের নেপথ্যের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স কালবেলাকে বলেন, ‘এই পরিসংখ্যান বা প্রতিবেদন আমাদের কাছে অতিরঞ্জিত মনে হয়েছে। এ ধরনের যেসব অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে, সেগুলো অনুসন্ধান করে আমরা দেখেছি এক পাড়ার সঙ্গে আরেক পাড়ার গ্যাঞ্জাম, জমি-সংক্রান্ত ঝামেলা, মসজিদ কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং ধারের টাকা চাইতে গিয়ে সৃষ্টি হওয়া গ্যাঞ্জামকে বিএনপির অন্তর্কোন্দল হিসেবে দেখানো হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বিএনপির নেতাকর্মীর মধ্যে নানা বিষয়ে মতবিরোধ থাকতে পারে, রাজনৈতিক কোনো ইস্যুতে অনৈক্য থাকতে পারে, কিন্তু সেটা তো অন্তর্কোন্দল নয়। তার পরও এত বড় একটা দলে বিচ্ছিন্নভাবে নানা ঘটনা ঘটতে পারে। দলীয় নেতাকর্মীদের কেউ কেউ অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারেন। তবে যারা এতে জড়াচ্ছে তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। দলীয় কারও অপরাধের প্রমাণ পেলে শুধু দল থেকে বহিষ্কারই নয়, দলের পক্ষ থেকে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।’

রাজনৈতিক কোন্দলে হানাহানি এবং প্রাণহানির বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক ইনামুল সাগর কালবেলাকে বলেন, ‘যারাই অপরাধ করুক না কেন আমরা তাদের নিয়ন্ত্রণ ও আইনের আওতায় আনতে সচেষ্ট ভূমিকা রাখছি। এসব ঘটনায় মামলা হচ্ছে, আসামি ধরা হচ্ছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশের যা করণীয় তাই করা হচ্ছে।’

অন্তর্কোন্দলে প্রাণহানির ঘটনাগুলোর মধ্যে গত ১৯ এপ্রিল রাউজানে খুন হওয়া মানিক আবদুল্লাহর ভাই সাকিল আহমেদ অভিযোগ করেন, ‘একই দলের প্রতিপক্ষের কিছু নেতাকর্মী তার ভাইয়ের ওপর তিন মাস আগেও হামলা করেছিল। ভাইয়ের ওপর ক্ষোভ থেকে তার কোচিং সেন্টার ও বোনের বাড়িতেও হামলা হয়। সেই সন্ত্রাসীরাই ভাইকে ভাত খাওয়ার সময় গুলি করে হত্যা করেছে।’

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাত থেকে বাঁচতে কয়েক বছর আগে মানিক সংযুক্ত আরব আমিরাতে চলে যান। গত বছরের ৫ আগস্টের পর দেশে ফেরেন। এরপর স্থানীয় রাজনীতিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি। একই এলাকায় চট্টগ্রাম জেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম আকবর খন্দকারের অনুসারীদের সঙ্গে রাজনৈতিক আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল মানিকের। এর জেরে গোলাম আকবর খন্দকারের অনুসারী যুবদলের আরাফাত মামুনের নেতৃত্বে এ হত্যাকাণ্ড হয় বলে রাউজানের রাজনীতিতে গুঞ্জন রয়েছে।

রাউজান থানার ওসি মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া গত বৃহস্পতিবার কালবেলাকে বলেন, ‘মানিক ও মামুন আগে একই গ্রুপের ছিলেন। তারা দুজনই দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। মাঝখানে মানিক আলাদা হয়ে যান। তখন দুজন একই রাজনৈতিক দলের আলাদা আলাদা নেতার হয়ে কাজ শুরু করেন। এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য রাজনৈতিক আধিপত্য, এলাকাভিত্তিক নিয়ন্ত্রণসহ অন্যান্য অনেক কিছু রয়েছে। আমরা জড়িতদের ধরার চেষ্টা করছি।’

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, মানিক ছাড়াও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের ২৮ আগস্ট থেকে সেখানে অন্তত ১০টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে সাতটিই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। এসব রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বিএনপির দলীয় নেতাকর্মীর সংশ্লিষ্টতাই বেশি। রাজনৈতিক পালাবদলের পর এলাকায় দুই নেতার অনুসারীর মধ্যে একাধিকবার সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম সানতু বলেন, ‘এসব ঘটনায় যাদের নাম আসছে তাদের নিজস্ব ও দলীয় পরিচয় আছে। যদিও অপরাধীর কোনো দল নেই। আমরাও অপরাধীদের অপরাধ দিয়েই চিহ্নিত করতে চাই।’