
ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে । বিভিন্ন অবকাঠামোর কিছু কাজ বাকি থাকলেও এই পথে নিয়মিত বাণিজ্যিক ট্রেন চলছে । তবে এই প্রকল্পে অর্থায়নকারী চীনের এক্সিম ব্যাংক শেষ পর্যায়ে ঋণের অর্থ ছাড় না করায় ঠিকাদারের বিল পরিশোধ নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে ।
প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে , চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণের অর্থ ছাড় না করায় ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ টি বিল বাবদ ঠিকাদারের প্রায় ১ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে । অর্থ ছাড়ের জন্য ব্যাংকটিকে গত বছর থেকে তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ । এ নিয়ে তিন থেকে চারবার এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের বৈঠক হলেও সমাধান হয়নি, ঋণের অর্থও ছাড় হয়নি ।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, সর্বশেষ ৭ এপ্রিল অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ( ইআরডি ) , চীনের এক্সিম ব্যাংক , রেলপথ মন্ত্রণালয় , বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালট্যান্টের প্রতিনিধিরা বৈঠক করেন । ওই বৈঠকে ঋণের অর্থ ছাড় না করার কারণ জানতে চেয়ে ইআরডি থেকে ব্যাংকটিকে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয় । একই সঙ্গে ২০২৪ সালের ২৪ অক্টোবর ব্যাংকটির প্রতিনিধিদলের প্রকল্প পরিদর্শনের প্রতিবেদনও পাঠাতে বলা হবে চিঠিতে ।
প্রকল্প সূত্র জানায় , পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ঋণের মেয়াদ চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত । এই সময়ের মধ্যে সব কাজ শেষ করে বিল পরিশোধ করতে হবে , না হলে জটিলতা তৈরি হবে । অর্থায়নকারী ঋণের টাকা ছাড় না করলে ঠিকাদার কাজ বন্ধ করে দিতে পারে । এতে হয়তো জটিলতা বাড়বে । এ ছাড়া শেষ সময়ে ব্যাংকটি টাকা না দিলে বাংলাদেশ সরকারকে নিজেদের টাকায় বাকি কাজ করতে হবে । এতে প্রকল্পে আবার সংশোধনী আনতে হবে । অবশ্য প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ আছে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত ।
বাংলাদেশ রেলওয়ের সূত্র বলছে , ২০২২ সালে ভাঙ্গা জংশনে বেশ কিছু বিষয় সংযোজন করা হয় । এতে এ ক্ষেত্রে চুক্তিতে দেখানো ব্যয়ের চেয়ে ৭৮ কোটি টাকা বেশি খরচ হচ্ছে । এ কারণে এক্সিম ব্যাংক ঋণের অর্থ ছাড়া দিচ্ছে না বলে শোনা যাচ্ছে । প্রকল্পের মার্চের অগ্রগতি প্রতিবেদন বলছে, প্রকল্পের কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৯৭.৩০ শতাংশ এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে ৮৮.৮০ শতাংশ । খোঁজ নিয়ে জানা গেছে , বর্তমানে প্রকল্পের তিন জায়গায় কাজ চলছে ।
এগুলোর মধ্যে রাজধানীর কমলাপুরে টিটিপাড়ায় আন্ডারপাস নির্মাণকাজের প্রায় ৭৫ শতাংশ শেষ হয়েছে । ভাঙ্গা জংশন নির্মাণকাজের প্রায় ৯০ শতাংশ এবং সেন্ট্রাল ট্রাফিক কন্ট্রোল ( সিটিসি ) সিস্টেম তৈরির কাজের ৯২ শতাংশ শেষ হয়েছে । প্রকল্পের সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো . আফজাল হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন,‘ প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ । রেললাইন চালু হয়েছে, ট্রেনও চলছে । এখন অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান টাকা না দিলে আমাদের চেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বে ঠিকাদার ।
এটি জিটুজি প্রকল্প, অর্থায়নকারী ও ঠিকাদার — উভয়ই চীনের । ফলে টাকা না পাওয়ার কোনো কারণ নেই । আমরা চীনের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি , তারা কিছু টাকা ছাড় করবে । ' তিনি বলেন , বর্তমানে প্রকল্পের শেষ পর্যায়ে কিছু ফিনিশিং কাজ চলছে , এতে খুব বেশি সমস্যা হবে না । অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান টাকা না দিলে ঠিকাদার যদি চলেও যায়, বাংলাদেশ সরকারের টাকা দিয়ে বাকি কাজ করা যাবে । ২০২৩ সালে এই প্রকল্পের একাংশ চালু করা হয় । পুরোদমে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ট্রেন চালু হয়েছে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে । এখন ট্রেনে ঢাকা থেকে খুলনায় যাওয়া যায় সাড়ে চার ঘণ্টায় । নতুন এই রেলপথ দিয়ে প্রতিদিন ৪৮ টি যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন চলাচল করতে পারবে । তবে এখন চলছে ১০ টি যাত্রীবাহী ট্রেন । উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে ( ডিপিপি ) এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা । তবে দ্বিতীয় সংশোধনীতে ৬২১ কোটি টাকা কমে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা ।
প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর চূড়ান্ত বিল অনুযায়ী আরও ১ হাজার ২২৩ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে । প্রকল্পের খরচ আরও কমবে কি না জানতে চাইলে রেলওয়ের মহাপরিচালক বলেন, প্রকল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু টাকা রাখা আছে । সেসব কাজ না হলে ব্যয় কিছুটা কমবে । তবে কত কমবে , সেটা এখন বলা যাচ্ছে না । প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে জিটুজি পদ্ধতিতে । এ প্রকল্পের ঠিকাদার চায়না রেলওয়ে গ্রুপ । প্রকল্পে চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে প্রায় ২৩ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা । বাকিটা বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব খাত থেকে ব্যয় করা হয় ।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ( বুয়েট ) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো . হাদিউজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ কোনো শর্তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে এক্সিম ব্যাংক তার ক্ষমতাবলে কিস্তি আটকে দিতেই পারে । সে ক্ষেত্রে বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আর্থিক চুক্তির শর্তগুলোতে আমাদের ভেবেচিন্তে একমত হওয়া উচিত । আর্থিক জটিলতার কারণে প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রকল্পের রিটার্নও ক্ষতিগ্রস্ত হবে । ফলে কতটুকু বুঝে আমরা চুক্তি করি , সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে । মনে রাখতে হবে , যারা অর্থায়ন করছে , সেগুলো অনুদান নয় , ঋণের সঙ্গে কিন্তু সুদও নেবে । '