Image description
গাজীপুরে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ নির্মাণসহ ১১টি কাজ । তথ্য দেওয়ার জন্য ফটোকপির ২২ টাকার বদলে চাওয়া হলো ৪৬ হাজার টাকা । শতকোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ, দুদকের অনুসন্ধান শুরু ।

শতকোটি টাকার বেশি দুর্নীতি হয়েছে। কিন্তু এই দুর্নীতি ঢাকতে তথ্য চাইলে তা না দিয়ে উল্টো প্রক্রিয়ার ফাঁদে ফেলে সাংবাদিককে ঘোরানো হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য বারবার অনুরোধ করা হচ্ছে তথ্য চাওয়ার আবেদন প্রত্যাহারের। এমন ঘটনা ঘটেছে গাজীপুরে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ নির্মাণসহ ১১টি কাজসংবলিত প্রকল্পে।

প্রকল্পের বিভিন্ন কাজের প্রাক্কলিত ব্যয়, কার্যাদেশে বরাদ্দের পরিমাণ, ব্যয় বৃদ্ধি হলে তার পরিমাণ, গত জানুয়ারি পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি, পরিশোধিত অর্থ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিকের নাম ও মোবাইল ফোন নম্বরএই সাত তথ্য চাওয়া হলে গাজীপুর গণপূর্ত কার্যালয় থেকে আবেদনকারীকে বারবার প্রক্রিয়ায় ফেলে সময়ক্ষেপণ করে।  শেষতক ১১ পৃষ্ঠা ফটোকপির মূল্য বাবদ যেখানে ২২ টাকা দরকার, সেখানে ৪৬ হাজার ৮০ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে তথ্য অধিকার আইনে আবেদনকারীকে ডাকযোগে চিঠি দিয়েছেন গাজীপুর গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী। গত ৬ ফেব্রুয়ারি কালের কণ্ঠের এই প্রতিবেদক আবেদন করেছিলেন। অবশ্য চিঠি পাঠানোর আগে একই কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ কামরুল আলম খান, সদ্য বিদায়ি উপবিভাগীয় প্রকৌশলী শাওন চৌধুরী ও নির্বাহী প্রকৌশলী শারমিন আক্তার তথ্য চেয়ে করা আবেদন প্রত্যাহারের অনুরোধ করেন। এমনকি এ বিষয়ে কোনো খবর না লিখতে নানাভাবে অনুরোধও করেন। 

জানা গেছে, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ প্রকল্পে স্থাপনা নির্মাণ ও ভূমি উন্নয়নে ৫৪২ কোটি ৮৯ লাখ ১৪ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অভিযোগ উঠেছে, প্রকল্প পরিচালক ডা. মো. মনিরুজ্জামান ও ঠিকাদারদের যোগসাজশে বালু ভরাট না করেই ভূমি উন্নয়ন প্রকল্প থেকে সাড়ে ছয় কোটি  ও ভেরিয়েশনের নামে গাজীপুর গণপূর্তের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী স্বপন চাকমা হাতিয়ে নিয়েছেন শত কোটি টাকার বেশি। নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করায় কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার আগেই ফাটল ধরে অবকাঠামোগুলোয়।

এ ছাড়া ২৭ লাখ টাকা ঘুষ না দেওয়ায় কার্যাদেশ বাতিল, বিল পরিশোধ না করায় প্রকৌশলী স্বপন চাকমার বিরুদ্ধে গাজীপুর যুগ্ম জজ প্রথম আদালতে মামলা করেন এস এইচ জয়েন্টভেঞ্চারের স্বত্বাধিকারী মো. মোনায়েম কবির। তিন কোটি ১৮ লাখ ২৯ হাজার টাকায় বালু ফেলে প্রথম পর্যায়ে ভূমি উন্নয়নের কাজ পেয়েছিলেন তিনি। ভূমি উন্নয়ন খাত থেকে ৬.৫ কোটি এবং কাশিমপুর কারাগারের পার্ট-২ ভেতরে আরসিসি সড়ক মেরামত না করে ৬৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তোলেন তিনি স্বপনের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগের বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও দুদকে লিখিত অভিযোগ দেয় জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি। অভিযোগ আমলে নিয়ে গত ৩ অক্টোবর গণপূর্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীকে (স্বাস্থ্য উইং) অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

এ ব্যাপারে দুদকও অনুসন্ধান শুরু করেছে। এসএইচ জয়েন্টভেঞ্চারের স্বত্বাধিকারী মোনায়েম কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, তিনি চূড়ান্ত বিল দাখিল করার পর স্বপন চাকমা তাঁর কাছে ২৭ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। তা দিতে না চাইলে সময়মতো কাজ সম্পন্ন করা হয়নি কারণ দেখিয়ে তাঁর কার্যাদেশ বাতিল করেন। বাধ্য হয়ে মোনায়েম স্বপন চাকমার বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের ১৯ জানুয়ারি গাজীপুর যুগ্ম জজ প্রথম আদালতে অর্থ আদায়ে মামলা করেন।

সূত্র জানায়, দরপত্রে দ্বিতীয় পর্যায়ে ভূমি উন্নয়নকাজে বালু ভরাটের গড় গভীরতা ছিল ১৫ ফুট ৭ ইঞ্চি। মাত্র তিন থেকে চার ফুট বালু ফেলে ভবন নির্মাণকাজ শুরু করা হয়। এতে ফিনিশড গ্রাউন্ড লেভেল (এফজিএল) নকশা অনুযায়ী হয়নি। কিন্তু ১২ ফুট বালু ভরাট দেখিয়ে ১২ কোটি টাকা বিল তুলে নেওয়া হয়। ওই বিল থেকে স্বপন চাকমা একাই নেন সাড়ে ছয় কোটি টাকা। বালু কম ফেলায় হাসপাতাল ভবনের চেয়ে একাডেমিক ভবন, ছাত্রাবাস, ডরমেটরি ভবন প্রায় ১০ ফুট নিচু হয়। তোপের মুখে পড়লে স্বপন তড়িঘড়ি হাসপাতাল থেকে একাডেমিক ভবনে যাতায়াতের করিডর নির্মাণ করেন। যে স্থানের ওপর দিয়ে করিডর নির্মাণ করা হয়েছে সেটি মূল নকশায় ছিল খেলার মাঠ। নাম না প্রকাশের শর্তে তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজের একাধিক শিক্ষক বলেন, প্রতিটি ভবন নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার আগেই ভবনগুলোর দেয়াল এবং ভেতরের সিসি সড়ক ও ড্রেনে ফাটল ধরেছে। বিশেষ করে সিসি ঢালাই সড়ক ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। ফাটল ঢাকতে সিমেন্টের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। 

ঢাকার আলোচিত ঠিকাদার জিকে শামীমের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে কাজ পাইয়ে দেওয়ায় গণপূর্তের অভিযুক্ত ১১ প্রকৌশলীর মধ্যে স্বপনও একজন। স্বপন এখন ঢাকার পূর্ত ভবণে সংস্থাপন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী।

বালু ভরাট না করে সাড়ে ছয় কোটি এবং কাশিমপুর কারাগার (পার্ট-২) অভ্যন্তরে আরসিসি রাস্তা মেরামতের ৬৫ লাখ টাকা তুলে আত্মসাতের অভিযোগে স্বপন চাকমার বিরুদ্ধে গত ২৪ সেপ্টেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ দায়ের করে গাজীপুর দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি। অভিযোগ আমলে নিয়ে স্বপন চাকমার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুদক। এ ছাড়া স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বালু ভরাট না করে সাড়ে ছয় কোটি এবং গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তর থেকে কাশিমপুর কারাগারের কাজ না করে রাস্তা মেরামতের ৬৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আলাদা তদন্ত শুরু করেছে। স্বপনের নিজ শহর রাঙামাটিতে ছয়তলা আলিশান ভবন, ঢাকায় ফ্ল্যাট এবং গাজীপুর মহানগরীর নীলেরপাড়ায় কিনেছেন এক বিঘা জমি।

এ প্রতিবেদক ৪৬ হাজার ৮০ টাকা জমা দেওয়ার বিষয়ে জানতে একাধিকবার অফিসে গেলেও নির্বাহী গণপূর্ত প্রকৌশলী শারমিন আক্তার কোনো কথা বলতে রাজি হননি। উল্টো এ বিষয়ে কোনো লেখালেখি না করার এবং তথ্য অধিকার আইনে করা আবেদনপত্র তুলে নেওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করেন।

সম্প্রতি তাঁকে শরীয়তপুরে বদলি করা হয়। অভিযোগের বিষয়ে প্রকৌশলী স্বপন চাকমার মোবাইলে একাধিকবার কল দিয়ে বন্ধ পাওয়া যায়। এ জন্য তাঁর বক্তব্য সংগ্রহ করা যায়নি।

দুদকের গাজীপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ও অনুসন্ধান কর্মকর্তা সাগর কুমার সাহা বলেন, স্বপন কুমার চাকমার দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। অনুসন্ধান শেষ হলে প্রতিবেদন কমিশনে পাঠানো হবে।