
স্বপ্নের দেশ জাপানে থাকা প্রবাসীরা বাংলাদেশ দূতাবাসের কাক্সিক্ষত সেবা থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছেন। তাদের অভিযোগ, জাপানে অবস্থানরত বাংলাদেশীরা সবচেয়ে বেশী সমস্যায় আছেন পাসপোর্ট নবায়ন ও নতুন পাসপোর্ট করা নিয়ে। এই সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ দূতাবাসে শরণাপন্ন হলেও তাদের থেকে তারা অনেকেই কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেন না। কারো কারো অভিযোগ, সেবা পেতে দূতাবাসের নম্বরে একবার দুবার নয়, শতবার ফোন করলেও কেউ রিসিভার তুলছেন না। এতে করে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশীই দূতাবাসের ওপর ক্ষুব্ধ এবং বিরক্ত।
গত ২৪ এপ্রিল বিকেলে জাপানের টোকিওস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের অডিটোরিয়ামে ই-পাসপোর্ট কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। রোমানিয়া থেকে সম্প্রতি যোগ দেয়া বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো: দাউদ আলী এই সেবার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ই-পাসপোর্ট সেবার উদ্বোধন ঘোষণার পর অনেক প্রবাসী খুশী হন। তারা কবে থেকে ই-পাসপোর্টের সেবা গ্রহণ করতে পারবেন তা জানতে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। এ ক্ষেত্রে এটা করতে কত জাপানী ইয়েন লাগবে, দূতাবাসে গিয়ে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে হবে না-কি অন্য কোনো ব্যবস্থা আছে এমন প্রশ্ন সামনে রেখে তারা দূতাবাসে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। কিন্তু দীর্ঘদিনের পুরনো অভিযোগ, জাপানের বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃপক্ষ কখনোই প্রবাসী বাংলাদেশীদের টেলিফোন ধরার সময় পান না। তাই তারা ক্ষুব্ধ হয়ে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের পরামর্শ দিয়ে বলছেন, আগে টেলিফোন ধরার অভ্যাস করুন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশের যে কয়টি শ্রমবান্ধব দেশ রয়েছে তার মধ্যে জাপান একটি। তবে সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইতালী, পোল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশের মতো জাপানে শ্রমিক যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। জাপান যেতে হলে অবশ্যই ওই কর্মীকে জাপানী ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে হবে। লেভেল এন ফাইভ অর্জনের পরই কর্মীদের সেখানে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। অনেকেই জাপান যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলেও শুধু জাপানী ভাষা রপ্ত করতে না পারার কারণে দেশটিতে কর্মী যাওয়ার হার নিম্নমুখী। এই সুযোগে জাপানের শ্রমবাজারটি নেপাল ও ভারতের শ্রমিকদের দখলে চলে যাচ্ছে বলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানান দিয়েছে। যদিও বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য যতটুকু সেবা করার সুযোগ রয়েছে তার অনেকটাই তারা করছেন না বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ ই-পাসপোর্ট সেবা কার্যক্রমের উদ্বোধন হওয়ার পর জাপানের রাজধানী টোকিও শহরের ভেতর এবং বাইরে অবস্থানরত অনেক প্রবাসী বাংলাদেশী দূতাবাসে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তারা দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। জাপানপ্রবাসী তারেক নামের এক কর্মী বলেন, ‘আমাদের প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাগুলোর উত্তর এই পেইজে ছোট করে দিয়ে দিতে পারলে অনেকের উপকারে আসবে। প্লিজ যে জিজ্ঞাসাগুলোর জন্য প্রজ্ঞাপনের প্রয়োজন নেই সেগুলোর বিষয়ে সম্ভাব্য উত্তর প্রত্যাশা করছি। কেননা আপনাদের টেলিফোনে কল দিয়ে পাওয়াটা অনেক কঠিন! যদিও ই-পাসপোর্ট কার্যক্রমের উদ্বোধনের পর নানা প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে জাপানের বাংলাদেশ দূতাবাস। তারা উল্লেখ করেন, ই-পাসপোর্ট সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য এ মাসের মধ্যে (এপ্রিল) জানানো হবে।
তারপরও জাপান প্রবাসী বাংলাদেশীরা দূতাবাসের কর্মকর্তাদের ওপর মনের ক্ষোভ ঝাড়া অব্যাহত রেখেছেন। রহমান সাইফুর নামের একজন প্রবাসী দূতাবাসের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, আমরা যারা টোকিওর বাইরে থাকি, তারা কিভাবে ই-পাসপোর্টের আবেদন করব। সোহান রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দূতাবাসে এক’শ বার কল দিলেও কেউ রিসিভ করে না। মেজবাহ উদ্দিন বলেন, আগে ফোন ধরার ব্যবস্থা করুন। অনুষ্ঠানের নামে এটা সেটা করলে কার কী উপকার হয়? এই ধরনের কোনো অনুষ্ঠান ভালো কোনো দেশের দূতাবাসে হয়? ভালো কোনো উদাহরণ সৃষ্টি করুন। সোহাগ রানা নামের একজন প্রবাসী ই-পাসপোর্ট সার্ভিস নেয়ার বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, আমরা যারা ওসাকাতে থাকি তাদের যদি টোকিও গিয়ে ই-পাসপোর্ট করতে হয় এবং বাস বা বিমান দিয়ে যেতে হয়, তাহলে আমাদের খরচ পড়বে যাওয়া আসা মিলিয়ে ১৮ থেকে ২২ হাজার জাপানী ইয়েন। তার সাথে যোগ হবে পাসপোর্ট ফি। তার চেয়ে আমরা ওসাকাবাসি (৬০ হাজার ইয়েন) দিয়ে দেশে গিয়ে ই-পাসপোর্ট করে আসাই ঠিক হবে। তাহলে সাথে কিছুদিন দেশে গিয়ে ঘুরেও আসা যাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাপানের বাংলাদেশ দূতাবাসে বেশির ভাগ কর্মকর্তা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত। ইতোমধ্যে তারা নানা কায়দায় নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। টেকনিক্যাল ইন্টার্ন শ্রমিক যেতে যেখানে জাপান সরকার কোনো টাকা নিচ্ছে না, সেখানে দূতাবাসের একটি সিন্ডিকেটকে হাত করে বাংলাদেশ থেকে লাখ লাখ টাকা খরচ করেই কর্মীদের জাপানে যেতে হচ্ছে। এসব বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্টদের আরো কঠোর মনিটরিংয়ের মধ্যে আনার দাবি জানান জাপানগামী এবং জাপানপ্রবাসী বাংলাদেশীরা।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যান বলছে, বিএমইটির মাধ্যমে সরকারিভাবে বিনা খরচে জাপানে টেকনিক্যাল ইন্টার্ন কর্মী যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রত্যেক কর্মীকে লেভেল এন ফাইভ ভাষা দক্ষতা অর্জন করতে হবে। শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি হলে হবে। বয়স হতে হবে ১৮-৩০ বছর। উচ্চতা কমপক্ষে ১৬০ সেন্টিমিটার হতে হবে। ইতোপূর্বে যারা জাপানে কর্মরত ছিলেন তারা আবেদন করতে পারবেন না। চলতি বছরের পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, আইএম জাপান কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে জানুয়ারি মাসে ৭৮ জন এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ৮০ জন গিয়েছেন। তবে বাংলাদেশের তুলনায় দেশটিতে নেপাল ও ভারত বিপুলসংখ্যক কর্মী পাঠাচ্ছে। তাদের কর্মী বেশি যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে তাদের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে জাপানী ট্রেনার দিয়ে। আর বাংলাদেশে বিএমইটি কর্তৃপক্ষ জাপান থেকে ফিরে আসা লোকদের প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছেন। তাই তাদের প্রশিক্ষণের মান সবসময় প্রশ্নবিদ্ধ থাকছে বলে খোদ টিটিসির অধ্যক্ষরাই নয়া দিগন্তের কাছে স্বীকার করছেন।