
করোনা মহামারিতে সারা বিশ্বেই ই-কমার্স ব্যবসার প্রসার ঘটে। তবে বাংলাদেশে ই-কমার্স প্রসারের সুযোগ নিয়ে প্রতারণায় জড়িয়ে পড়ে অধিকাংশ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। তারা লোভনীয় মূল্যছাড়ের নানা ফাঁদে ফেলে আত্মসাৎ করে শত শত কোটি টাকা। অনেক প্রতিষ্ঠান এসব টাকা বিদেশেও পাচার করে। এসব ঘটনায় ২০২১ সালে অন্তত ৬০টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে সামনে রেখে মানি লন্ডারিং আইনে অনুসন্ধান শুরু করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এই কার্যক্রম যেন শুরু আছে, শেষ নেই অবস্থা। চার বছরের বেশি সময় ধরে অনুসন্ধান ও তদন্তের পর মাত্র ৪টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তারা মামলার তদন্ত শেষ করেছে। অন্যদিকে ১০টি মামলা ছাড়াও অনুসন্ধানের দীর্ঘ তালিকা ঝুলছে বছরের পর বছর ধরে।
জানা গেছে, ই-কমার্স প্রতারণার ঘটনায় সারা দেশে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, থানা ও আদালতের মামলা এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদসহ বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া তথ্যে অন্তত ৬০ ই-কমার্সকে চিহ্নিত করে সিআইডি। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান পরিচালনায় নেতৃত্ব দেয় সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট। এরপর বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর থেকে চিহ্নিত ই-কমার্সের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এরপর ধারাবাহিকভাবে ১ হাজার কোটির বেশি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে ১৪টি ই-কমার্সের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হয়। অন্যদিকে অনুসন্ধানের তালিকায় থাকা অধিকাংশ ই-কমার্সের বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি (অর্গানাইজড ক্রাইম উইং) একরামুল হাবিব যুগান্তরকে বলেন, মানি লন্ডারিং আইনে করা মামলার তদন্ত পুরোপুরি তথ্য-উপাত্তনির্ভর হওয়ায় অন্য মামলার তুলনায় সাধারণত বাড়তি সময় লেগে যায়। এর মধ্যে ই-কমার্সের এই মামলাগুলোর অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য পেতে সময় লেগেছে। এছাড়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বদলি হওয়ায় তদন্ত শেষ করতে বাড়তি সময়ের প্রয়োজন হচ্ছে। সিআইডি জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ৪টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত শেষ করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস, ২৪ টিকিট, আকাশ নীল, ই-অরেঞ্জ। অনুসন্ধান শেষে তদন্তাধীন থাকা ৮ ই-কমার্সের মধ্যে রয়েছে আলিশা মার্ট, আলিফ ওয়ার্ল্ড মার্কেটিং লিমিটেড, দালাল প্লাস ডটকম, সিরাজগঞ্জ শপ ডটকম লিমিটেড, ধামাকা, আনন্দের বাজার, অ্যামাস বিডি এবং ওয়ালমার্ট। এর মধ্যে থলে ডটকমের মামলার তদন্ত শেষে এমই অনুমোদন করা হয়েছে। এছাড়া রিং আইডি বিডি লিমিটেড নামের একটি ই-কমার্সের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত রিপোর্টে তথ্যগত ভুল দেখিয়ে ফের তদন্ত করা হচ্ছে। তবে মামলাগুলোর তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে রাজি হননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সিআইডির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সাবেক সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া ই-কমার্সের মামলার তদন্তে প্রত্যক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করেছেন। ফলে এসব মামলার তদন্ত গুরুত্ব না পেয়ে যথাসময়ে শেষ করা যায়নি।
রিং আইডি বিডি লিমিটেড : গ্রাহকদের ৩০২ কোটি টাকা সরিয়ে নেওয়ার ঘটনায় ২০২২ সালে মামলা করে সিআইডি। গত বছর তদন্ত শেষে প্রতিষ্ঠানের অভিযুক্ত তিন কর্মকর্তাকে অব্যাহতির সুপারিশ করে চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়া হয়। এরপর এ বছর জানুয়ারিতে চূড়ান্ত রিপোর্টে তথ্যগত ভুল দেখিয়ে ফের তদন্ত শুরু করে সিআইডি। তবে চূড়ান্ত রিপোর্টের পর জব্দ থাকা অর্থ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। যাবতীয় তথ্য ফের সংগ্রহ করে মামলার কার্যক্রম শুরু করা হবে বলে জানা গেছে।
আলিফ ওয়ার্ল্ড মার্কেটিং লিমিটেড : ২০২২ সালে ৭৮ লাখ টাকা লন্ডারিংয়ের অভিযোগে মামলা করা হয়েছিল এই ই-কমার্সের বিরুদ্ধে। তদন্তে তাদের ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনায় ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা পাওয়া গেছে। পেমেন্ট গেটওয়েতে থাকা এই অর্থ আদালতের অনুমতি পেলে গ্রাহকদের ফেরত দেওয়া সম্ভব হবে। এছাড়া অন্যান্য সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়নি। এ কারণে তদন্ত শেষ করা সম্ভব হয়নি।
ওয়ালমার্ট : গ্রাহকদের ৩৩ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০২৩ সালে মামলা করে সিআইডি। পরে অভিযুক্ত ২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। মামলার তদন্তে ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে, তাদের অনেকেই টাকা ফেরত পাওয়ার কথা জানিয়েছেন সিআইডিকে। জানা গেছে, তদন্তাধীন এই মামলার বিষয়ে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সিরাজগঞ্জ শপ ডটকম লিমিটেড : দীর্ষ অনুসন্ধান শেষে ২০২২ সালে মানি লন্ডারিং মামলা করে সিআইডি। তদন্তে তাদের ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনায় কোনো অর্থ পাওয়া যায়নি। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে অন্য কোনো সম্পদ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
দালাল প্লাস : গ্রাহকদের শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে ভুক্তভোগীদের মামলার পর ২০২২ সালে মানি লন্ডারিং মামলা করে সিআইডি। এরপর তাদের ব্যাংক হিসাব স্থগিত ও প্রতিষ্ঠানটির সিইও এবং ডিরেক্টরকে গ্রেফতার দেখানো হয়। ব্যাংক হিসাবে থাকা ২ কোটি টাকা ফ্রিজ করা হয়। লম্বা সময় তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই। সম্প্রতি নতুন তদন্ত কর্মকর্তা এই মামলার তদন্ত শুরু করেছেন।
একইভাবে নানা অজুহাতে ঝুলছে ধামাকা, আনন্দের বাজার, থলে ডটকম, অ্যামাস বিডি ও আলিশা মার্টের তদন্ত। ফলে গ্রাহকের অন্তত হাজার কোটি টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।