
এক বছরের ব্যবধানে ফের রক্তাক্ত কাশ্মীর। সামপ্রতিক সময়ে এটিই সবচেয়ে মারাত্মক হত্যাকাণ্ড। ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার পহেলগাঁওয়ের বৈসরণ উপত্যকায় মঙ্গলবারের সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় অন্তত ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। একজন বাদে সবাই পর্যটক। নিহতদের মধ্যে দুইজন বিদেশিও রয়েছেন বলে জানা গেছে। নিহতদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন সদ্য বিবাহিত। সবুজ বাগান ও পাহাড়ে ঘেরা উপত্যকায় এই মৌসুমে গমগম করে পর্যটকের ভিড়ে। এলাকাটি পর্যটকদের কাছে ‘মিনি সুইজারল্যান্ড’ নামে জনপ্রিয়। মঙ্গলবারেও সেই চেনা ছবিই দেখা গিয়েছিল পহেলগাঁওয়ের উপত্যকা জুড়ে। মঙ্গলবার দুপুরের পর রক্তাক্ত হয়ে ওঠে বৈসরণ উপত্যকা। বুধবার গোটা কাশ্মীর জুড়ে পরিস্থিতি থমথমে হয়ে রয়েছে। পর্যটকরা দ্রুত কাশ্মীর ছেড়ে চলে আসতে শুরু করেছেন। বুধবার কাশ্মীরের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল পহেলগাঁওয়ের সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানাতে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সংহতি প্রকাশের জন্য কাশ্মীর বন্ধ পালন করেছে। সেনাকর্তারা নিশ্চিত করেছেন যে, বৈসরণ উপত্যকায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের একটি দলকে লক্ষ্য করে এই হামলা চালানো হয়েছে। অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা পর্যটকদের ওপর গুলি চালায়। হামলাকারীরা সংখ্যায় ছিল পাঁচ-ছয়জন। নিহতরা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের বাসিন্দা। পশ্চিমবঙ্গের তিন বাসিন্দাও নিহতদের মধ্যে রয়েছেন। রাজ্যে রাজ্যে শোকের আবহ বিরাজ করছে।
সেনাবাহিনীর তরফে জানানো হয়েছে, সন্ত্রাসীদের সন্ধানে সেনাবাহিনী বিশেষ অভিযানে নেমেছে। ব্যবহার করা হচ্ছে হেলিকপ্টারও। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ভূস্বর্গে সন্ত্রাসবাদী হামলায় পর্যটকদের মৃত্যুর ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে টেলিফোনে কথাও বলেন। ট্রাম্প জানিয়েছেন, ভারত ও আমেরিকা যৌথ ভাবে জঙ্গিহানার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বুধবার একথা জানিয়েছেন। মঙ্গলবার রাতেই এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে লস্কর-ই-তৈয়বার ছায়া সংগঠন দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত বার্তায় তারা অসন্তোষ প্রকাশ করে লিখেছে, ৮৫ হাজারের বেশি ‘বহিরাগত’ এ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছে, যা জনসংখ্যাগত উপাত্তে পরিবর্তন আনছে। তবে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ পহেলগাঁওয়ের হত্যাকাণ্ড থেকে ইসলামাবাদকে দূরে সরিয়ে রেখে এই সহিংসতাকে ভারতের ‘স্বদেশে জন্মানো’ এবং ভারতের বিরুদ্ধে বৃহত্তর বিদ্রোহের অংশ বলে বর্ণনা করেছেন।
সমাজমাধ্যমে এক সংক্ষিপ্ত বার্তায় তিনি লিখেছেন, এর সঙ্গে আমাদের একেবারেই কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা সকল ধরনের এবং সর্বত্র সন্ত্রাসবাদকে প্রত্যাখ্যান করি। ভারত বুধবার দুপুর পর্যন্ত এ ব্যাপারে কারও বিরুদ্ধে দোষারোপ না করলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আগেই এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের রেয়াত করা হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। বুধবারই তিনি সৌদি আরব সফর সংক্ষিপ্ত করে ভারতে ফিরে এসেছেন। বিমানবন্দরে অবতরণের পরই তিনি সেখানে জাতীয় উপদেষ্টা অজিত দোভাল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর ও অন্যান্য আধিকারিকদের নিয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন। এদিকে, হামলার ঠিক আগের একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সমাজমাধ্যমে। সেই ভিডিওতে ধরা পড়েছে এলোপাতাড়ি গুলির শব্দ। ভাইরাল হয়েছে ভিডিওটি। ভিডিওর শুরুতে দেখা গিয়েছে এক ব্যক্তি গাছের আড়াল থেকে ক্যামেরার দিকে হাত নাড়তে নাড়তে এগিয়ে আসছেন। পেছনে সবুজ নৈসর্গিক দৃশ্য। হঠাৎ করেই শোনা যায় মুহুর্মুহু গুলির শব্দ। সঙ্গে ভেসে আসতে থাকে আর্তচিৎকার। সরকারি সূত্রে সংবাদ সংস্থাকে জানানো হয়েছে, গোটা এলাকা জুড়ে সন্ত্রাসীদের খোঁজে সেনা অভিযান চলছে।
মঙ্গলবার রাতেই ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ শ্রীনগরে এসে নিরাপত্তা নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বুধবার তিনি নিহতদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে সমবেদনা জানিয়েছেন। ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো প্রশ্ন তুলেছেন, এমন হামলা হতে পারে সেই গোয়েন্দা তথ্য কেন ছিল না রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। বিরোধীদের মতে, কাশ্মীর শান্ত হয়ে পড়েছে বলে যে দাবি করা হয়েছিল তা যে ঠিক নয়, তা ফের স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। হামলার নিন্দা করে গোটা দেশকে এক থাকার বার্তা দিয়েও কেন্দ্রকে আক্রমণ করেছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। তিনি বলেন, জম্মু-কাশ্মীরে সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে, এই ধাঁচের ফাঁকা দাবি না করে সরকারের উচিত ওই ঘটনার দায় নিয়ে পদক্ষেপ করা যাতে এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে না ঘটে। তিনি বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহর সঙ্গে কথাও বলেন। মঙ্গলবারের হত্যাকাণ্ড নিয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে নিন্দা জানানো হচ্ছে। বলিউড ও টলিউডের সকলে নিন্দা জানিয়েছেন। পিছিয়ে নেই ক্রীড়া অঙ্গনও।
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড সন্ত্রাসী হামলার নিন্দার পাশাপাশি আইপিএল ম্যাচে মাঠে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হবে বলে জানিয়েছে। আরও জানা গেছে, এদিনের ম্যাচে মুম্বই ও হায়দরাবাদের ক্রিকেটাররা কালো আর্মব্যান্ড পরে খেলবেন। আর্মব্যান্ড পরে থাকবেন আম্পায়াররাও। এদিনের খেলায় কোনো চিয়ারলিডার থাকবে না। আইপিএলে সাধারণত প্রতিটি ম্যাচে বাজি ও আলোর প্রদর্শনী হয়। দুই ইনিংসের বিরতিতে হয় আলো ও লেজারের প্রদর্শনী। খেলা শেষে হয় বাজির প্রদর্শনী। কিন্তু বুধবারের ম্যাচে সে সবও বন্ধ থাকবে বলে জানানো হয়েছে। পহেলগাঁওয়ে হত্যাকাণ্ডে জড়িত চার জঙ্গিকে শনাক্ত করেছে ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো। ইতিমধ্যে চার জনের ছবিও প্রকাশ করে পরিচয় জানানো হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, চার জঙ্গি হলো- আদিল, আসিফ ফুজি, সুলেমান শাহ এবং আবু তালহা!
এদিকে এই হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা নাকচ করেছে পাকিস্তান। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ জম্মু ও কাশ্মীরে সহিংসতার জন্য ‘বিপ্লব’ এবং ‘দেশীয় সন্ত্রাসী বাহিনীকেই’ দায়ী করেছেন। আসিফের দাবি, হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের কোনো যোগসূত্র নেই। এগুলো সবই দেশীয়, ভারত সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজ্যে বিপ্লব চলছে, একটি নয়, দুটি নয়, বরং কয়েক ডজন। নাগাল্যান্ড থেকে কাশ্মীর, দক্ষিণের রাজ্য, ছত্তিশগড়ে, মণিপুরে সর্বত্র। তিনি আরও বলেন, এই ঘটনার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা কোনো পরিস্থিতিতেই সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করি না এবং স্থানীয় কোনো সংঘর্ষে নিরীহ মানুষদের লক্ষ্যবস্তু করা উচিত নয়। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কথায়, আমাদের জাতীয় নীতিতে বেসামরিকদের লক্ষ্যবস্তু করার অনুমতি নেই। কিন্তু যদি সেনাবাহিনী বা পুলিশ ভারতের কোথাও তাদের অধিকার দাবি করা মানুষদের ওপর নৃশংসতা চালায় এবং তার পরিবর্তে যদি তারা বিদ্রোহ করে, অস্ত্র তুলে নেয়- তাহলে পাকিস্তানের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেয়া বোধহয় সহজ। আসিফ আরও বলেন যে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অস্থিরতা সৃষ্টিতে ভারতের জড়িত থাকার অভিযোগের প্রমাণ ইসলামাবাদ অনেকবার দিয়েছে। আসিফের কথায়, আমরা আগেও প্রমাণ দিয়েছি- একবার নয় বরং বহুবার যে, ভারত বেলুচিস্তান এবং পাকিস্তানের অন্যান্য অঞ্চলে অস্থিরতা সৃষ্টিতে মদত দিচ্ছে। তারা আফগানিস্তানে বসে থাকুক বা অন্য কোথাও, পাকিস্তানে অস্থিরতা তৈরিতে মদত দেয়ার ভারতের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।