
বেড়েই চলেছে দুর্নীতি দমন কমিশনে জমা পড়া অভিযোগের সংখ্যা। গত বছরের ৫ই আগস্টের পর থেকে এই সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। দুদক বলছে গত তিন মাসেই প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার অভিযোগ সংস্থাটিতে জমা পড়েছে। সমন্বিত জেলা কার্যালয়, প্রধান কার্যালয় এবং দুদকের হটলাইনে (১০৬) এসব অভিযোগ আসছে প্রতিনিয়ত। দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, যাচাই-বাছাই শেষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থাও নিচ্ছে কমিশন। তবে অভিযোগ আমলের ক্ষেত্রে দুদকের আইন ও বিধি মেনেই নেয়া হচ্ছে।
দুদক সূত্র বলছে, গত জানুয়ারি মাস থেকে চলতি মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত মোট ৫ হাজার ৪৫১টি অভিযোগ আবেদন আকারে জমা হয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ১ হাজার ৯২৩, ফেব্রুয়ারিতে ১ হাজার ৬২৬, মার্চে ১ হাজার ৪০০ ও এপ্রিলে (১৫ তারিখ পর্যন্ত) ৫০২টি অভিযোগ জমা পড়ে। সংস্থাটির সূত্র আরও জানায়, এই সাড়ে পাঁচ হাজার অভিযোগের মধ্যে অন্তত এক হাজারটি অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেয়া হয়েছে। সেগুলোর কার্যক্রমও চলমান।
দুদক জানায়, ২০১৮ সালের রাতের ভোট আয়োজনের সঙ্গে জড়িত শতাধিক ব্যক্তিকে অনুসন্ধানের আওতায় আনা হয়েছে। এর মধ্যে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদাসহ চার কমিশনারের বিরুদ্ধে চলছে অনুসন্ধান। অন্যদিকে অভিযোগ অনুযায়ী প্রশ্নবিদ্ধ সেই নির্বাচনটি আয়োজনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের অর্থ ক্ষতি সাধনের দায়ে আরও শতাধিক রাজনৈতিক ব্যক্তি, আমলাকে আইনের আওতায় আনার প্রস্তুতি চলছে দুদকে। হাজারো রোহিঙ্গাকে জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার অভিযোগে সাবেক সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে সংস্থাটি। সে সঙ্গে এই সাবেক সচিবকে রাতের ভোট আয়োজনের নেপথ্যের কারিগর হিসেবেও চিহ্নিত করে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে অপর একটি অনুসন্ধান দল।
এদিকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সাবেক চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমানের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান করছে দুদক। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় ১৩(এ) ধারায় বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ব্যক্তি আমলাদের প্লট সুবিধা দেয়ার অভিযোগে একগুচ্ছ ঊর্ধ্বতন রাজউক কর্মকর্তাও আসছেন দুদকের অনুসন্ধানে। এই সব মিলিয়ে এক হাজারেরও বেশিসংখ্যক ব্যক্তি অনুসন্ধানের আওতায় এসেছেন শুধু এই সাড়ে তিন মাসে।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে সারা বছরেই মাত্র ৮৪৫ অভিযোগ আমলে নিয়েছে তৎকালীন মঈনউদ্দিন আবদুল্লাহ কমিশন। সে বছর মামলা হয়েছে মাত্র ৪০৪টি। তার বিপরীতে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর ড. আবদুল মোমেন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পরপর সহস্রাধিক অভিযোগ অনুসন্ধান আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে। আর সর্বশেষ দুই মাসেই শতাধিক মামলা করেছে বর্তমান কমিশন।
অন্যদিকে ২০২২ সালে ১৯ হাজারের বেশি অভিযোগের মধ্যে অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেয়া হয়েছিল ৯০১টি। আর সে বছর মামলা হয় ৪০৬টি। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, ১৪ হাজার ৭৮৯টি অভিযোগের মধ্যে আমলে নেয়া হয় ৫৩৩টি। আর সে বছর মামলা দায়ের করা হয় ৩৪৭টি। ২০২০ সালের হিসাবেও অনেক কম অভিযোগ আমলে নেয়া হয়। বছরটিতে অভিযোগ আসে ১৮ হাজার ৪৮৯টি। আর আমলে নেয়া হয় ৮২২টি। এ সময় মামলা দায়ের হয় মাত্র ৩৪৮টি।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর প্রতিদিন গড়ে দুইশ’র বেশিসংখ্যক অভিযোগ জমা পড়ছে সংস্থাটির বিভিন্ন দপ্তরে। এর মধ্যে রাজধানীর সেগুনবাগিচার প্রধান কার্যালয়ে চেয়ারম্যানের বরাবর আসা অভিযোগের সংখ্যাই বেশি। এ ছাড়া দুদকের হটলাইনসহ (১০৬) বিভিন্ন সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে প্রতিদিন অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়ছে।
দুদুকের এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, আগস্ট মাস থেকে সহস্রাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। যা নজিরবিহীন। এ যাবৎকালে এত অভিযোগ জমা পড়তে দেখা যায়নি। আর সে অনুপাতে অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেয়ার সংখ্যাটাও অনেক। এসব অভিযোগের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে। বর্তমানে দুদকের যাচাই-বাছাই কমিটিতে (যাবাক) সাড়ে তিন হাজারের বেশি অভিযোগ জমা রয়েছে। যা যাচাই-বাছাইয়ের পর সিদ্ধান্ত নেবে দুদক।
এদিকে এসব অনুসন্ধান ও মামলা পরিচালনা নিয়ে বেশ কিছু জটিলতায় পড়েছেন অনেক কর্মকর্তা। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক দুদক কর্মকর্তা মানবজমিনকে জানিয়েছেন, একদিকে বিপুলসংখ্যক অনুসন্ধান, অন্যদিকে মামলার তদন্ত কার্যক্রম। দুই মিলিয়ে কর্মকর্তারা চাপে পড়েছেন। কমিশনের পক্ষ থেকে তোড়জোড় করে মামলা দায়েরের নির্দেশনা থাকায় সেই নির্দেশ মানা হচ্ছে। কিন্তু অনেক মামলা দ্রুত করতে গিয়েও ভুলভ্রান্তি থেকে যায়। ফলে আইনের ফাঁক-ফোকরে আসামিরা আদালতে গিয়ে কোনো না কোনোভাবে পার পেয়ে যান। দুদক কর্মকর্তাদের মতে, একটি অনুসন্ধান যত গভীরে গিয়ে করা যায় ততই মামলা তদন্তের জন্য ভালো হয়। এতে ভুলভ্রান্তি কম থাকে। ফলে আদালতে গিয়ে মামলার সাজাও সহজে নিশ্চিত করতে পারে দুদক।
অভিযোগ জমা পড়ার বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-এর (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, এত অভিযোগ জমা পড়ছে তার মানে দুর্নীতি বেড়েছে সেটা এখনই বলার সময় আসেনি। দুদকের মানদণ্ড অনুযায়ী নিরপেক্ষ থেকে দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনবে- এটাই সবার প্রত্যাশা। তিনি আরও বলেন, দেশ থেকে কর্তৃত্ববাদী সংস্কৃতি অবসান ঘটলেও যারা ক্ষমতার কাছাকাছি বা নিজেদের ক্ষমতায় আছেন বলে মনে করছেন তাদের দখলবাজি, চাঁদাবাজি চলছে। সেই সংস্কৃতির পরিবর্তন হয়নি। দুদকের উচিত হবে সব ক্ষমতার ঊর্ধ্বে গিয়ে তাদের সক্ষমতার প্রমাণ দেয়া।