
দেশের ১০ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে বসবাস করা শিক্ষক- কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত হারে বাড়িভাড়া না কাটায় দুই অর্থবছরে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২৬ কোটি টাকার বেশি । এই ১০ টিসহ ২৫ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরীক্ষায় ১৮৭ টি অনিয়ম পাওয়া গেছে । এসব অনিয়মে মোট আর্থিক ক্ষতি ১ হাজার ৪১৪ কোটি ৩৩ লাখ ৩৫ হাজার ৭০১ টাকা । বাংলাদেশ মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের ( সিএজি ) অধীন শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এই অনিয়ম ও আর্থিক ক্ষতির চিত্র উঠে এসেছে । প্রতিবেদনে ওই টাকা আদায়ের পাশাপাশি দায়ীদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে ।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখভালের দায়িত্বে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ( ইউজিসি ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ বলেন,‘ যেসব অনিয়মের কথা হয়েছে, তা আমাদের সময়ের নয় । সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এগুলোর জবাব দেবে । ইউজিসিও এসব আর্থিক অনিয়মকে কোনো প্রশ্রয় দেবে না । বিধি অনুযায়ী আমরাও ব্যবস্থা নেব ।' ২৫ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব সম্পর্কিত ২০২০-২০২১ ও ২০২১-২০২২ অর্থবছরের এই অডিট ইন্সপেকশন রিপোর্ট সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠানো হয়েছে । নিরীক্ষা প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে । শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বলেছে , সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিয়ম অনুযায়ী অডিট আপত্তির জবাব দেবে । এরপর বিধি অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে ।
দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৫৭ টি । এগুলোর মধ্যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়নি । এ ছাড়া অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১১৭ টি । বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১১৭ টি । নিরীক্ষা করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি), ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) , সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি), পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (পাবিপ্রবি), হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (হাবিপ্রবি), খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় , কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স), শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (শেকৃবি), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমান নাম কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়), চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট), জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট), বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি), হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় , নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় , খুলনার শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমান নাম খুলনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) । এসব অনিয়মের বিষয়ে বক্তব্য জানতে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে মোবাইলে ফোন করা হলে তাঁরা বক্তব্য দিতে অপারগতা জানান । তাঁরা বলেছেন, এসব অনিয়ম তাঁদের সময়ে হয়নি । বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে ।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে , এই ২৫ টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশির ভাগ অনিয়ম হয়েছে বিভিন্ন খাতে বিধিবহির্ভূতভাবে শিক্ষক - কর্মকর্তাদের ভাতা ও সম্মানী দেওয়া , ভবন নির্মাণ ও কেনাকাটায় সরকারি বিধি না মেনে অর্থ ব্যয়ে । এ ছাড়া ভর্তি পরীক্ষার ফি বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা না দেওয়া , ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা না দেওয়া , ভুয়া ভাউচার - কোটেশনে অর্থ উত্তোলন , বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সংগঠনে সরকারি অর্থ বরাদ্দ দেওয়া , অর্ধকোটি টাকার মোবাইল বিল দেওয়ার মতো অনিয়ম হয়েছে । শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের অডিট আপত্তির বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ( নিরীক্ষা ও আইন ) বেগম বদরুন নাহার বলেন , বিষয়টি তাঁর জানা নেই । খোঁজ নেবেন । প্রতিবেদনে বলা হয়েছে , বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন খাতে অনিয়মিতভাবে বরাদ্দের অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে ৩৯ কোটি ৬৩ লাখ ৫৯ হাজার ৭৫৭ টাকা , শিক্ষকদের প্রাপ্যতা ছাড়াই দায়িত্ব ভাতা দেওয়া হয়েছে ৬ কোটি ২ লাখ ৪ হাজার ৪২০ টাকা , শিক্ষকদের ১৮ কোটি ৯০ হাজার ৮ টাকা অগ্রিম দিলেও সমন্বয় করা হয়নি । সরকারি অর্থে বাস্তবায়িত প্রকল্পের ব্যয় না হওয়া অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না দেওয়ায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৬২ কোটি ৪৯ লাখ ৪৫ হাজার ৪০৩ টাকা । বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে ঋণ পরিশোধের অতিরিক্ত ব্যয় দেখানোয় ৫৫ কোটি ২৯ লাখ ১৪ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে । এ ছাড়া পাবিপ্রবিতে ঠিকাদারের মাধ্যমে নিম্নমানের বই সরবরাহের উদ্যোগের কারণে সরকারের ১২ কোটি ১৫ লাখ ৬৯ হাজার ৬০৭ টাকা ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে । নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , পাবিপ্রবি , হাবিপ্রবি , চবি , বাকৃবি , শেকৃবি , চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি , ডুয়েট , ইবি ও যবিপ্রবির
শিক্ষক - কর্মকর্তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জবি ও বাকৃবিতে ২০২১ সালের কোয়ার্টারে বসবাস করলেও তাঁদের বেতন থেকে নির্ধারিত হারে বাড়িভাড়া কাটা হয়নি । এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২৫ কোটি ৯০ লাখ ৮৩ হাজার ৪৪৯ টাকা । এর বাইরে পাবনায় পাবিপ্রবির গেস্টহাউস থাকলেও ঢাকায় গেস্টহাউস ভাড়া করে ভাড়া পরিশোধ করা হয়েছে ১৮ লাখ ৩০ হাজার টাকা । প্রতিবেদনে এসব অর্থ আদায় করে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী , পাবিপ্রবি , শাবিপ্রবি , নোবিপ্রবি , জবি , বুটেক্স , যবিপ্রবি ও জাবির কয়েকজন শিক্ষক শিক্ষা ছুটি শেষে কর্মস্থলে না ফিরলেও তাঁরা নিয়মিত বেতন তোলায় সরকারের ক্ষতি হয়েছে ৬ কোটি ৪৩ লাখ ৪৩ হাজার ৫৪৯ টাকা পাবিপ্রবির কলা , সামাজিক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান অনুষদে ১২ কোটি ১৫ লাখ টাকার বই কেনার উদ্যোগের বিষয়ে বলা হয়েছে , নিরীক্ষা দল কার্যাদেশ পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গুদাম পরিদর্শন করে দেখেছে , বইগুলো নিম্নমানের কাগজে ফটোকপি করে তৈরি করা হয়েছে । তাই তদন্ত কমিটি করে মানদণ্ড যাচাই করে বইগুলো গ্রহণের তাগিদ দিয়েছে । প্রতিবেদনে বলা হয় , রাবিতে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে ঋণ গ্রহণ বাবদ কোনো প্রাপ্তি দেখানো না হলেও ঋণ পরিশোধের নামে ৫৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা বাজেট দেখানো হয়েছে । নিরীক্ষা দল কোন খাতে এই ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে বা ঋণ গ্রহণের উৎস দেখতে চাইলে তার কোনো ব্যাখ্যাও দিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়টি । প্রতিবেদনের তথ্য বলছে , জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দেনাদারদের কাছে পাবে ৩০ কোটি ৩১ লাখ ৭৩ হাজার ৫২১ টাকা । এই টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দেওয়ার সুপারিশ করেছে নিরীক্ষা কমিটি । জবিও নিজস্ব গবেষণা নীতিমালা ছাড়াই অনিয়মিতভাবে গবেষণা প্রকল্প কার্যক্রম বাবদ ব্যয় করেছে ২ কোটি ৪২ লাখ টাকা ।
গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার আয় থেকে ৩৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা বিধিবহির্ভূত সম্মানী বাবদ বিতরণ করা হয়েছে বলে অনিয়ম পেয়েছে নিরীক্ষা দল । প্রতিবেদন বলছে , রাবির ২০২১-২২ অর্থবছরে স্নাতক প্রথম বর্ষ ভর্তি পরীক্ষা থেকে আয় হওয়া ১৭ কোটি ৮২ লাখ ৬৮ হাজার টাকা নিরীক্ষায় উপস্থাপন করা হয়নি । যবিপ্রবিতে ভর্তি ফরম বিক্রির ১ কোটি ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ৬২০ টাকা তহবিলে জমা দেওয়া হয়নি । প্রাপ্যতা না থাকলেও আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের ৪৯ লাখ ৪০ হাজার ৯২১ টাকা মোবাইল বিল দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয় , চতুর্থ গ্রেডের নিচের কর্মকর্তারা মোবাইল বিল ভাতা প্রাপ্য নন । ১৩ টি বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যদের সংগঠন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদকে ৩৪ লাখ ৬১ হাজার ৯৭ টাকা অনিয়মিতভাবে চাঁদা দিয়েছে ।
এ ছাড়া ইউজিসির অনুমোদন ছাড়া শিক্ষক - কর্মকর্তা নিয়োগ ও পদোন্নতি , বাজেটের অতিরিক্ত খরচ , প্রাপ্যতা না থাকা সত্ত্বেও জ্বালানি ব্যয় , বিভিন্ন কাজে ভ্যাট কর্তন না করা , বিভিন্ন কাজে ঠিকাদারদের চুক্তির বাইরে বিল প্রদান , শিক্ষকদের ঋণ দেওয়া , বিশ্ববিদ্যালয়ের দোকান কিংবা মার্কেটের ভাড়া আদায় না করা , কর্মচারীদের যাতায়াত ভাতা , বাড়তি দামে কেনাকাটায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় । ২৫ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ( টিআইবি ) নির্বাহী পরিচালক ড . ইফতেখারুজ্জামান বলেন , অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে । জনগণের করের টাকা যারা নয়ছয় করেছে , তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে ।