
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কয়েক মাস ধরে ট্যাপের পানিতে আসছে ছোট ছোট পোকা আর ময়লা। পানির রং পাল্টেছে, আছে দুর্গন্ধ। কোনোরকম ধোয়ামোছা, রান্না ও গোসলের কাজ সারতে পারলেও খাওয়ার অযোগ্য এ পানি। খিলগাঁও, বনশ্রী, কল্যাণপুর, শেওড়াপাড়া, মহাখালী, বাড্ডা, বাংলামটর, তেজগাঁও, মালিবাগ, মগবাজার, মুগদা, যাত্রাবাড়ী, বাসাবো, জুরাইনসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব এলাকার বাসিন্দারা এখন চরম পানি সংকটে ভুগছেন। বারবার অভিযোগ জানানোর পরও সমস্যার সমাধান হয়নি। উল্টো দুর্গন্ধযুক্ত পানির সঙ্গে পোকা ও ময়লা আসার দায় নিচ্ছে না ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা)। ফলে হাজার হাজার মানুষ ময়লা ও অনিরাপদ পানি ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছেন।
খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়ার ৮ নম্বর সড়কের বাসিন্দা ফাতেমা তুজ জোহরা বলেন, ‘১৫ থেকে ২০ দিন ধরে পানির সঙ্গে লাল কেঁচো ও সাদা লার্ভার মতো পোকা আসছে। সম্প্রতি দুইবার বাসার দুটি ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করানো হলেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে পানি কিনে খাচ্ছি।’ বনশ্রীর বাসিন্দা মামুন খান জানান, ‘আমাদের আশপাশের প্রায় প্রতিটি বাসাতেই পানিতে ছোট ছোট কেঁচো পাওয়া গেছে। আমরা ওয়াসাকে অভিযোগ জানিয়েছি; কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি।’ একই অভিযোগ করেন কল্যাণপুরের রোড-১৩ এলাকার বাসিন্দা নঈমুর রহমানও। তিনি বলেন, ‘এক সপ্তাহ ধরে আমাদের পরিবারের সবাই চর্মরোগে ভুগছেন। ওয়াসার পানি ভর্তি ছিল পোকায়। অসহ্য চুলকানি হতো। বাধ্য হয়ে বোতলের পানি কিনে খাচ্ছি। আমাদের পানির ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করেও সমস্যার সমাধান হয়নি।’
নিউইস্কাটনের বাসিন্দা আবুল হাসান বলেন, ‘প্রথমে ভেবেছিলাম ময়লা, পরে দেখি পানিতে ছোট ছোট পোকা আর কেঁচো। এই পানি ব্যবহারের অনুপযোগী। সমস্যাটা দেখার পর বাড়িওয়ালাকে জানিয়েছিলাম। ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করার পরও পোকা আসা বন্ধ হয়নি। ওয়াসাতেও অভিযোগ দিয়েছি; কিন্তু তারা কোনো পদক্ষেপই নেয়নি।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানির এই সমস্যা নগরীতে ছড়িয়ে পড়েছে, এতে বাড়ছে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগের প্রকোপ। অনতিবিলম্বে সমস্যার সমাধান জরুরি এবং ওয়াসা কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারে না।
তবে ঢাকা ওয়াসার এমওডিএস জোন-৬-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইমরানুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা একাধিকবার অভিযোগ আসা এলাকাগুলোর পানির লাইন পরীক্ষা করেছি; কিন্তু ওয়াসার পক্ষ থেকে কোনো ত্রুটি পাইনি। সমস্যাটা বাড়ির ভেতরের ট্যাঙ্ক বা পাইপলাইনে থাকতে পারে। আমাদের পরিদর্শনে ওয়াসার পানিতে কোনো পোকা বা সমস্যা ধরা পড়েনি।’
জুরাইন ও মুরাদপুর এলাকায় ওয়াসা যে পানি সরবরাহ করছে, তা ঘোলা ও তীব্র দুর্গন্ধযুক্ত, এখন ঘোলা পানির সঙ্গে আসছে পোকাও। স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘বাচ্চাকে গোসল করানোর পরে চুলকানি হচ্ছে শরীরে। ওষুধ খাওয়াচ্ছি কমছে না।’
আহসান হাবিব নামে এক বাসিন্দা বলেন, ‘বাসায় যে পানি আসে, তা ঘোলা, তীব্র দুর্গন্ধ। এজন্য পানি কিনে খেতে হয়। মাঝে মাঝে কাদার মতো ঘোলা পানি আসে। পানির সঙ্গে পোকাও আসে। খাওয়ার জন্য পানি কিনে আনি। দিনে ২০ টাকার পানি লাগে। কয়েক বছর ধরে এ এলাকায় পানি সংকট স্থায়ী রূপ নিয়েছে।’
মগবাজারের মধুবাগের নাজমুল তপন বলেন, ‘গত দুই সপ্তাহ ধরে আমাদের এলাকার, বিশেষ করে খেজুর গাছ গলির আশপাশের এলাকায় ওয়াসার পানিতে পোকা গিজগিজ করছে। ওয়াসার কর্মকর্তারা এসে সমস্যা দেখে গেছেন; কিন্তু পোকার সংখ্যা উল্টো বেড়েছে। মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। ওয়াসা যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে আমাদের প্রতিবাদে নামতে হবে।’
তবে ঢাকা ওয়াসা এসব অভিযোগের দায় নিচ্ছে না। সম্প্রতি ঢাকা ওয়াসা এক বিজ্ঞপ্তিতে আনুষ্ঠানিকভাবে দাবি করছে, গ্রাহকদের বাসাবাড়িতে ভূগর্ভস্থ ও ছাদে পানি সংরক্ষণের যে ট্যাংক আছে, সেখানেই সমস্যাটি হচ্ছে। এসব পরিষ্কার করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে; কিন্তু অনেক গ্রাহক ওয়াসার কথামতো পানির ট্যাংক পরিষ্কার করেও কোনো ফল পায়নি।
ঢাকা ওয়াসার এমওডিএস জোন-৪-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ বদরুল আলম বলেন, ‘ওয়াসার পাইপলাইনে কোনো সমস্যা পাওয়া যায়নি। আমরা অভিযোগ পেয়ে কল্যাণপুরের বাসাবাড়িগুলোতে গিয়েছি এবং অভিযোগের সত্যতা পেয়েছি; কিন্তু আমাদের পাইপলাইনের পানি স্বচ্ছ এবং জীবাণুমুক্তই পেয়েছি। অধিকাংশ বাড়ির পানির ট্যাংকে পোকা জন্ম নিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘লাইনের পানি প্রবাহমান থাকে, তাই লাইনে এমন পোকা জন্ম নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে পাইপলাইনে কোথাও ফাটা কিংবা অন্য কোনো উৎস থেকে সমস্যা হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে আমরা আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি।’
ঢাকা ওয়াসার একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এ সময়ে নদীর পানি দুর্গন্ধ ও পোকাযুক্ত বেশি থাকে। ফলে ট্রিটমেন্টে অতিরিক্ত কেমিক্যাল দিতে হয়। ফলে কোথাও সমস্যা হলে লাইনে দুর্গন্ধযুক্ত পানি যেতে পারে। এ ছাড়া ঢাকার অনেক জায়গায়ই ওয়াসার লাইনে লিকেজ রয়েছে, যেখানে এই সমস্যা ঘটতে পারে। তাছাড়া অবৈধ সংযোগের কারণেও পানির সমস্যা হতে পারে।’
ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) এ কে এম শহীদ উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘গত কয়েকদিনে কল্যাণপুর, মগবাজার, মধুবাগ, আরকে মিশন রোড থেকে পানির সমস্যা নিয়ে অন্তত ৪০টি অভিযোগ পেয়েছি। প্রতিটি জায়গায় আমাদের লোক পাঠিয়ে চেক করিয়েছি; কিন্তু সরবরাহ লাইনের পানিতে কোনো সমস্যা পাইনি। আমাদের পরিশোধিত পানিতে ক্লোরিন মিক্স করে পাঠানো হয়। ফলে এমন পোকা থাকলেও তা মারা যাওয়ার কথা।’
তিনি বলেন, ‘ওয়াসার ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টগুলোর পানি নিয়মিত পরীক্ষা করা হয়। কোথাও পানিতে সমস্যা পাইনি। ঢাকায় বর্তমানে প্রতিদিন ২৮৫ থেকে ২৯০ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করছি, যার মাত্র কয়েকটি স্থানে অভিযোগ পাচ্ছি। এসবের অধিকাংশই বাড়িগুলোর ওয়াটার রিজার্ভার পরিষ্কার করে না—এটাই সমস্যা।’
তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাইপলাইনে পোকা পাওয়া মানেই লাইনের কোথাও ফাটল বা রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি আছে। পোকাযুক্ত পানি ব্যবহার করলে ত্বকে সংক্রমণ, পেটের অসুখসহ নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে শিশুরা পানি খেলে মারাত্মক অসুখ হতে পারে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদ লেনিন চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ওয়াসার পানি খাবারসহ নৈমিত্তিক কাজকর্মে ব্যবহার করে নগরবাসী। এই পানির পাইপে পোকা জন্মানোর অর্থ হচ্ছে বাইরের দূষণ পাইপের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। এই পানি মানুষের পান করার উপযোগিতা হারিয়েছে। এই পানি পান করলে ডায়রিয়া, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস, খাদ্য বিষক্রিয়া, চর্মরোগসহ নানা সমস্যায় ভুগতে হয়। গত কয়েকদিনে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে ডায়রিয়ার রোগীও বেড়ে গেছে। তাই জোর করে হলেও ওয়াসার চলমান এই সমস্যার সমাধান করা জরুরি। মহামারি আকার ধারণ করার আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিনি বলেন, পানিবাহিত রোগ নগরের প্রতিটি মানুষকে প্রভাবিত করে। সামর্থ্যবান লোকগুলো অসুস্থ হলে উৎপাদনের জায়গায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ সম্মিলিত শ্রমঘণ্টা কমে যাবে। পানি উৎপাদন থেকে শুরু করে খাবার টেবিলে সুপেয় পানি সরবরাহের দায়িত্ব হচ্ছে ওয়াসার। কিন্তু বছরের পর বছর ওয়াসাকে দুর্নীতি এবং অনিয়মের আখড়ায় পরিণত করেছেন বিগত সময়ের যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা। তাই এখন উচিত, ওয়াসার পূর্ণ সংস্কার করা। দরকার হলে সব বাজেট বন্ধ করে দিয়ে স্থানীয় সরকারের হাতে দিতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের ব্যবহৃত পানিতে কোনো গন্ধ, রং, বর্ণ থাকবে না; তা সুপেয় ও জীবাণুমুক্ত হতে হবে। ঢাকা ওয়াসায় পানি সরবরাহ হয় দুইভাবে। গভীর নলকূপ থেকে ও নদীর পানি দূষণমুক্ত করে সরবরাহ করে। উত্তোলনকৃত স্থান থেকে সরবরাহকৃত স্থানে পানির পাইপে কোনো ছিদ্র না থাকলে গভীর নলকূপের পানিতে সাধারণত কোনো দূষণ থাকে না। পরিশোধিত পানিতে অক্সিজেন দিয়ে সুপেয় করার চেষ্টা করা হয়। পাশাপাশি কিছু কেমিক্যালযুক্ত করে জীবাণুমক্ত করা হয়। ট্রিটমেন্ট প্লান্টের সক্ষমতার চেয়ে পানিতে যদি দূষণের মাত্রা অত্যধিক বেশি হয়, তবে তাতে দুর্গন্ধ থেকে যায়। এই পানি সরবরাহ করা হলে দুর্গন্ধ থাকতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘ওয়াসা যে পাইপ দিয়ে পানি সরবরাহ করে, সেটা যদি ফেটে লিক হয়, তাহলে পানিতে জীবাণু ঢুকতে পারে। অনেকখানে চোরাই লাইনের কারণে পানি দূষিত হয়। ওয়াসার পাইপ ফুটো করে চোরাই লাইনের পানি বেশিরভাগ নেওয়া হয় ড্রেনের মধ্য থেকে। যখন পানি সরবরাহ থাকে না তখন পাইপের মধ্যে নেগেটিভ প্রেসার তৈরি হয়। দূষিত পানি, পোকামাকড় পাইপের মধ্যে ঢুকে পড়ে। তখন ময়লাযুক্ত পানি ওয়াসার পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ হয়। গ্রীষ্মকালে যখন নদীর পানি কমে যায় তখন দূষণের মাত্রা বেড়ে যায়। আমরা কখনোই এমন পানি চাই না। নদীর পানি যেন দূষণমুক্ত থাকে, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। আমাদের পানির যত সোর্স আছে সেগুলোকে রক্ষা করতে হবে।’