Image description

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের ভাই নাসির উদ্দিন লিটু। লিটুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স নূরই এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের প্রভাব দেখিয়ে কাউখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণের কাজ বাগিয়ে নেওয়া হয়। ওই প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয় ২০০৮ সালের ২৫ জুন।

বরাদ্দ ছিল পাঁচ কোটি টাকা। কার্যাদেশ অনুসারে, ৩১ থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করার কর্মসূচির আওতায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজ ছিল দুটি আবাসিক ও একটি বহির্বিভাগ ভবন নির্মাণের। তবে শেষ পর্যন্ত কাজ শেষ করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। কাজ না করেই অতিরিক্ত ৭১ লাখ টাকা আত্মসাতের চেষ্টা করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানের কাজ না করার জেরে প্রায় ১৭ বছর ধরে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা সুবিধা বাড়ছে না। ওই প্রকল্পও বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পিরোজপুর কার্যালয় জানায়, লিটুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নকশা অনুসরণ না করেই নির্মাণকাজ শুরু করেছিল। ২০ শতাংশ কাজ করার পর আর কাজ করেনি। ওই কাজের বিপরীতে এক কোটি ৩৫ লাখ টাকার বিল দাখিল করা হয় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে। তার বিপরীতে তোলা হয় ৪৮ লাখ টাকা। কাজের এই হাল কেন হলো তা দেখতে ২০১২ সালের ১৯ মার্চ অধিদপ্তরের বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। মূল্যায়ন প্রতিবেদন পর্যালোচনায় বেরিয়ে আসে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৬৩ লাখ ২০ হাজার টাকার কাজ করেছে, কিন্তু এক কোটি ৩৫ লাখ টাকার বিল দাখিল করেছে। কাজ না করেই অতিরিক্ত ৭১ লাখ টাকা আত্মসাতের চেষ্টা করে।

ফলে ৪৮ লাখ টাকার বিল পাসের পর আর কোনো বিল অনুমোদন দেয়নি অধিদপ্তর। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ না করায় অধিদপ্তর ২০১৪ সালের ২৫ জুন নূরই এন্টারপ্রাইজের কার্যাদেশ শুধু বাতিল করে। পরে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের প্রভাবে তাঁর ভাই লিটুর নির্মীয়মাণ ভবনের কাজ পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এক পর্যায়ে দুদক এই দুর্নীতির অনুসন্ধানে নামে। কার্যাদেশ নিয়ে কাজ ফেলে রেখে সরকারের প্রায় অর্ধকোটি টাকার ক্ষতিসাধন, অতিরিক্ত ৭১ লাখ টাকা আত্মসাতের চেষ্টা, প্রকল্পে ভবনগুলোর ভিতসহ (ফাউন্ডেশন) কলাম দুর্বল করে ভবনের স্থায়িত্ব কমিয়ে সরকারি সম্পদের ক্ষতিসাধনের প্রাথমিক সত্যতা পায় দুদক। তার ভিত্তিতে দুদকের উপসহকারী পরিচালক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন সম্রাট গত সোমবার দুদকের পিরোজপুর জেলা সমন্বিত কার্যালয়ে মামলা করেন। জানা গেছে, মামলায় লিটু ছাড়াও স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তিন প্রকৌশলীকে আসামি করা হয়। তবে সব আসামিই পলাতক রয়েছেন। লিটু ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পিরোজপুর কার্যালয়ের সাবেক সহকারী প্রকৌশলী বজলুর রহমান খান, একই অধিদপ্তরের বরিশাল কার্যালয়ের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী দুলাল চন্দ্র সরকার, সাবেক উপসহকারী প্রকৌশলী শৈলেন্দ্র নাথ মন্ডল। আসামিদের মধ্যে বজলুর অবসরে গেছেন। দুলাল খুলনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর চলতি দায়িত্ব থেকে এলপিআরে রয়েছেন। শৈলেন্দ্র ঝালকাঠিতে সহকারী প্রকৌশলী পদে আছেন। প্রকল্পের ঠিকাদার লিটু বরিশাল নগরীর খিরোদ মুখার্জি লেনের বাসিন্দা। লিটু গত ৫ আগস্টের পর থেকেই পলাতক আছেন।

এদিকে নূরই এন্টারপ্রাইজের দরপত্রের কার্যাদেশ বাতিলের পাশাপাশি নির্মীয়মাণ ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। পরিত্যক্ত ভবনের পাশেই নতুন করে ভবন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০২২ সালের ২৪ জুলাই মেসার্স কোহিনূর এন্টারপ্রাইজকে ২৫ কোটি ১১ লাখ টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এক বছরের মধ্যে ভবনের নির্মাণকাজ শেষ করার কথা ছিল। ২০২৩ সালের ৩১ মে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলী সরেজমিনে দেখতে পান, মাত্র ১৬ শতাংশ কাজ হয়েছে। পরে তাঁর সুপারিশ অনুসারে, মেসার্স কোহিনূর এন্টারপ্রাইজের কার্যাদেশ বাতিল করে অধিদপ্তর। তবে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কার্যাদেশ বাতিলের আদেশের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে। স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর পিরোজপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী তানজিলা ফেরদৌসী কালের কণ্ঠকে বলেন, নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করতে না পারায় মেসার্স কোহিনূর এন্টারপ্রাইজের কার্যাদেশ বাতিল করা হয়। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি কার্যাদেশ বাতিলের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে। আদালত ছয় মাসের জন্য স্থগিতাদেশ দেন। স্থগিতাদেশ ৫ আগস্টের পর শেষ হলেও নতুন ভবনটির কাজের জন্য পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা যাচ্ছে না। মামলা নিষ্পত্তি হলে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা হবে।