Image description

দেশের খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোকে ৩৮ হাজার কোটি টাকা কৃষি ও পল্লিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ব্যাংকগুলো গড়ে ২৪ হাজার ৮৬০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার ৬৫ দশমিক ৪২ শতাংশ। তবে এই ঋণ বিতরণে পিছিয়ে আছে ২১টি ব্যাংক। এর মধ্যে ১২টি ব্যাংকের কৃষি ও পল্লিঋণ বিতরণের হার লক্ষ্যমাত্রার ৫০ শতাংশেরও কম। এ ছাড়া দুটি ব্যাংক কোনো ঋণই বিতরণ করতে পারেনি। আরও সাতটি ব্যাংকের ঋণ বিতরণের পরিমাণ ২০ শতাংশ বা তার চেয়েও কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে এ তথ্য উঠে এসেছে।

ব্যাংকাররা বলছেন, কৃষিঋণ বিতরণে পরিমাণের পাশাপাশি মানের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। যাতে সব ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণ করে সে জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেসব বাণিজ্যিক ব্যাংকের পল্লি অঞ্চলে নিজস্ব শাখা নেই, সেসব ব্যাংক যাতে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার বা এনজিও মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করে সে ব্যাপারেও নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ (এমআরএ) নিবন্ধিত ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার মাধ্যমে কৃষিঋণ বিতরণ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সুদ নির্ধারণেও এমআরএ নির্ধারিত সুদহারের চেয়ে বেশি সুদ না নেওয়ার বিষয়েও নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) বেসরকারি খাতের পদ্মা ব্যাংক ও বিদেশি উরি ব্যাংক কৃষি ও পল্লি খাতে কোনো ঋণ বিতরণ করতে পারেনি। এ ছাড়া অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে লক্ষ্যমাত্রার ১০ শতাংশেরও কম ঋণ বিতরণ করেছে দুটি ব্যাংক—বেসরকারি খাতের ইউনিয়ন ব্যাংক ও বিদেশি এইচএসবিসি। এই সময়ে লক্ষ্যমাত্রার ১৫ শতাংশের কম ঋণ বিতরণ করা ব্যাংকের সংখ্যা তিনটি—বেসরকারি মধুমতি ব্যাংক ১২ দশমিক ৯৭ শতাংশ, শরিয়াহভিত্তিক ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ১৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ ও আইএফআইসি ব্যাংক ১৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে। উল্লেখিত সময়ে ২০ শতাংশ বা তার কম ঋণ বিতরণ করেছে সাউথইস্ট ব্যাংক (১৬ দশমিক ২১ শতাংশ) ও সিটিজেন ব্যাংক (২০ শতাংশ)। এ ছাড়া ২০ শতাংশের বেশি কিন্তু ৫০ শতাংশের কম ঋণ বিতরণ করেছে—এমন ব্যাংকের সংখ্যা ১২টি। ব্যাংকগুলো হলো—স্ট্যান্ডার্ড, প্রিমিয়ার, গ্লোবাল ইসলামী, যমুনা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ন্যাশনাল, এনসিসি, শাহজালাল ইসলামী, স্যোসাল ইসলামী, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স, ডাচ-বাংলা ও এক্সিম ব্যাংক।

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার কৃষি ও কৃষি সংশ্লিষ্ট কাজে অর্থ সরবরাহ নিশ্চিত করতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য মোট ঋণের অন্তত ২ শতাংশ কৃষি খাতে বিতরণ বাধ্যতামূলক করেছে। যেসব ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কৃষিঋণ বিতরণ করবে না, তাদের জন্য জরিমানার ব্যবস্থা রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে সেসব ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রার অর্থ বিতরণে ব্যর্থ হবে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট তহবিলে ওই অর্থ জমা দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। এর ফলে প্রতি বছরই সাধারণ ঋণ বিতরণের পাশাপাশি বাড়ছে কৃষিঋণ বিতরণ। এ জন্য বছরের শুরুতে লক্ষ্যও ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে, যাতে বছরের বারো মাস বিশেষ করে ফসল চাষের শুরুতে কৃষকরা সময়মতো ঋণ পান। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কৃষিঋণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৩৮ হাজার কোটি টাকা। ২০০৯-১০ অর্থবছরে কৃষিঋণের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার কোটি টাকারও কম। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে বিতরণকৃত কৃষি ও পল্লিঋণের মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ১০ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিদেশি ব্যাংকগুলো ৯৬৫ কোটি এবং বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ১৩ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, কৃষি ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে কিছু ব্যাংকের সক্ষমতার ঘাটতি আছে। আবার চলতি অর্থবছরে রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলার অবনতিসহ নানা কারণে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করতে পারেনি। আবার কিছু কিছু ব্যাংকে তারল্য সংকটও রয়েছে। সব মিলিয়ে অনেক ব্যাংক সক্ষমতা থাকার পরও ঝুঁকি বিবেচনায় ঋণ বিতরণ করতে পারেনি।

তবে অর্থবছরের মধ্যেই সিংহভাগ ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণ বিতরণ সম্পন্ন করবে বলে আশাবাদী এই ব্যাংকার। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কৃষিঋণ বিতরণের বিপরীতে কৃষকের ঋণের অর্থ ফেরত দেওয়ার হার সন্তোষজনক। আবার কৃষিঋণে খেলাপি কৃষকের হারও তুলনামূলক কম। তথ্য বলছে, কৃষিঋণে খেলাপির হার ৯ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। মার্চ শেষে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৫৬ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ মাত্র ৫ হাজার ১৬১ কোটি টাকা।

ব্যাংকাররা বলছেন, কৃষকরা কখনো ঋণ জালিয়াতি করেন না। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন কারণে মাঝে মধ্যে সমস্যায় পড়েন তারা। কিন্তু দেশের বৃহৎ শিল্প গ্রুপের মতো ঋণখেলাপির প্রবণতা তাদের মধ্যে একেবারেই নেই। তবুও কৃষকদের স্বল্প অর্থের ঋণ আদায়ে বেশি তৎপর ব্যাংকগুলো।

তথ্য বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে কৃষি খাতে বিতরণ করা ঋণের বিপরীতে আদায় হয়েছে ২৭ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। আর মার্চ শেষে এই খাতে বকেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার ২২৯ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছর ব্যাংকগুলোকে লক্ষ্যমাত্রার ন্যূনতম ১৩ শতাংশ ঋণ মৎস্য খাতে দিতে হবে। প্রথম ৯ মাসে এই খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ১৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। আর লক্ষ্যমাত্রার অন্তত ১৫ শতাংশ ঋণ দেওয়ার কথা প্রাণিসম্পদ খাতে। আলোচ্য সময়ে পশুসম্পদ ও পোলট্রি খাতে বিতরণ করা হয়েছে ৬ হাজার ১১০ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার ২৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এ ছাড়া ৯ মাস শেষে দারিদ্র্য বিমোচনে ৯৯৪ কোটি, শস্য খাতে ১১ হাজার ৬৭৫ কোটি, কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ১৭৬ কোটি, সেচ যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ১৬০ কোটি, শস্য গুদামজাত ও বিপণন খাতে ৮৯ কোটি এবং মৎস্য চাষে ৩ হাজার ৭২৩ টাকার ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো।