Image description
চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতায় প্রাণহানি

চট্টগ্রাম নগরের চট্টেশ্বরী সড়ক লাগোয়া বড় নালাটির ধার ঘেঁষেই চলতে হয় শত শত মানুষকে। সড়কের পাশেই চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের প্রধান ছাত্রাবাসসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আছে বহু আবাসিক এলাকাও। নালাসংলগ্ন সড়কে চলাচলে তাই ভিড়ের কারণে বা অন্য কারণে পড়ে গেলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকছেই।

আর বর্ষা তো দূরের কথা, সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তা-নালা একাকার হয়ে যায়। রিকশা থেকে পানিতে পড়লে শিশুদেরও প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। শুধু এই সড়ক নয়, চট্টগ্রাম নগরের বহু এলাকায় সড়কের পাশে খাল-নালা-নর্দমায় চলাচলে প্রাণের ঝুঁকি বাড়ছে। শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সী লোকজন এসব দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, গত সাড়ে আট বছরে ১৩ জনের প্রাণহানি হয়েছে। সর্বশেষ গত শুক্রবার নগরের কার্পাসগোলায় ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে হিজড়া খালে পড়ে ছয় মাসের সেহরিশের প্রাণহানি ঘটে। খালটিতে পড়ার ১৪ ঘণ্টা পর কয়েক কিলোমিটার দূরে চাক্তাই খালের চামড়া গুদাম এলাকা থেকে সেহরিশের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এই করুণ প্রাণহানি নিয়ে আবারও আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে।

চট্টগ্রামে খাল-নালায় পড়ে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনার বিষয়ে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, সেবা সংস্থাগুলোর দায়িত্বহীনতার কারণে একটা দুরবস্থা তৈরি হয়েছে। বহু এলাকায় বর্ষাকালে পানির কারণে খাল ও রাস্তা চেনা যায় না। ঝুঁকিপূর্ণ খালগুলোর পাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী দিতে হবে। এ জন্য চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে প্রকল্প নিতে হবে।

তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগে যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে সেগুলোর বাস্তবায়নে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএর তদারকি তেমন জোরদার নয়।

সংস্থাগুলোর অধীনে প্রকল্পগুলোর কাজে আছে ধীরগতি। জানা গেছে, জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম নগরে বড় তিন মেগা প্রকল্পে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। এসব প্রকল্পের অধীনে বেশির ভাগ কাজ শেষ হলেও কিছুদিন পর পর খাল-নালায় পড়ে মৃত্যুর ঘটনা কমছে না। প্রাণহানির পর কিছুদিন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে কর্মতৎপরতা দেখা গেলেও কিছুদিন পর তারা থেমে যায়। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে কাজের সমন্বয় নেই। বিষয়টি নিয়ে বারবার বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠছে। খাল-নালায় পড়ে লোকজনের  হতাহতের দায় কারচট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নাকি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ)?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির জন্য কোনো সংস্থাই দায় এড়াতে পারে না। ২০২১ সালে নালায় পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। তৎকালীন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ওই তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন। তদন্তে উঠে আসে, নালায় তলিয়ে মৃত্যুর ঘটনায় দায় উভয় সংস্থারই রয়েছে। নগরের সেবা সংস্থাগুলোর কাজে সমন্বয়হীনতার বিষয়ে সমন্বয় নেই এমন অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসিডিএর চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, এখন অবশ্য সমন্বয় হচ্ছে।

গতকাল রবিবার সকালে নগরের চশমাহিলের পাশে চশমাখাল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, খালের পাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী হিসেবে বাঁশ বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এসব বাঁশের ফাঁক দিয়েই লোকজন ভেতরে ঢুকছে। সেখানে চলাচলকারী রহিম উদ্দিন বলেন, খালে কয়েক বছর আগে অটোরিকশা পড়ে দুজন মারা গিয়েছিল। খালের পাশে শক্ত প্রতিরোধক া গড়ে না তুলে কিছু বাঁশ দিয়ে দায়সারা কাজ করা হয়েছে। প্রশ্ন করা হলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএর চেয়ারম্যান বলেন, সিডিএর সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের অধীনে ৩৬টি খালের মধ্যে ২৪টির কাজ শেষ হয়েছে। গত শুক্রবার যেখানে দুর্ঘটনা (হিজড়া খাল) ঘটেছিল ওই খালসহ ১২টি খালের কাজ শেষ হয়নি। তবে ওই স্থানে বাঁশ দিয়ে বেষ্টনী দেওয়া ছিল। কিন্তু কে বা কারা সেখান থেকে বাঁশ তুলে নিয়ে গিয়েছিল। সিডিএর সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের কাজ যেখানে হচ্ছে সবখানে রিটেইনিং ওয়াল ও রেলিং দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেছেন, গত শুক্রবারের দুর্ঘটনাটি দুঃখজনক।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী মো. আনিসুর রহমান সোহেল বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে বড় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। সিডিএ ৩৬টি খালের কাজ যেখানে করছে সেখানে আমরা (চসিক) কাজ করছি না। এর বাইরে নালা-নর্দমা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও একটি নতুন খাল (বহদ্দারহাট বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত) করছি আমরা। তবে রাস্তার পাশে খাল-নালা-নর্দমা যেখানে আছে সেসব স্থানে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়ার জন্য প্রকল্প নেওয়া হবে।

প্রকল্প বেহাল : নগরে জলাবদ্ধতা নিরসনে তিনটি মেগাপ্রকল্পের কাজ চলছে। এর মধ্যে দুটি সিডিএ ও একটি চসিকের অধীনে। সিডিএর বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের মধ্যে কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু হয়ে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্প ২০১৭ সালের জুনে নেওয়া হয়। দুই হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্প আট বছরে শেষ হয়নি। প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ৮২ শতাংশ। আগামী জুন থেকে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এ ছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল খনন, পুনর্খনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়নে সিডিএর আরো এক প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে আট হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। এই প্রকল্পও প্রায় আট বছর আগের। এটিরও মেয়াদ শেষ হবে আগামী জুনে। প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৭৮ শতাংশ। অন্যদিকে চসিকের বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত ২.৯ শতাংশ দৈর্ঘ্য ও ৬৫ ফুট প্রস্থবিশিষ্ট নতুন খাল খনন প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে এক হাজার ৩৬২ কোটি টাকা। ২০১৪ সালের জুন মাসে নেওয়া এই প্রকল্পে এ পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৮৩ শতাংশ। সব মিলিয়ে চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা নিরসনে ওই তিন মেগাপ্রকল্পে গড়ে ৮০ শতাংশ কাজ হয়েছে।