Image description
ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোর বর্ষসেরা

মাহমুদ আজুরের পরিচিতি এখন বিশ্বজুড়ে। তবে যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ পরিচিতি জুটেছে তার কপালে; সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই সে ঘটনার দুঃসহ স্মৃতি মনেও রাখতে চাইত না শিশুটি। অথচ আজীবন সেই স্মৃতির ধকল শরীরে বয়ে বেড়াতে হবে মাত্র ৯ বছর বয়সী শিশুটিকে। গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার স্মরণীয় এক প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবে সে।

আজুরকে নিয়ে একটি স্থিরচিত্র এ বছর ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোর বর্ষসেরা পুরস্কার জেতার পর তাকে চিনেছে পুরো বিশ্ব। গাজায় গত বছর ইসরায়েলের ড্রোন হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয়ে দুটি হাত খোয়াতে হয়েছে আজুরকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার প্রতিটি শিশুকে যে জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে—হাত না থাকায় আজুরের সেই সংগ্রাম আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। পুরস্কার পাওয়া ছবিটিতে আজুরের চোখজুড়ে যে গভীর অনিশ্চয়তা এবং বিষাদ ফুটে উঠেছে, তা নাড়িয়ে দিয়েছে সবার বিবেক।

মাহমুদ আজুরের মুখে তার আহত হওয়ার এবং পরবর্তী সময়ের বর্ণনা শুনে কেঁপে উঠবে পাষাণ হৃদয়ও! সম্প্রতি কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আলজাজিরার সঙ্গে এক আলাপনে মাহমুদ আজুরের কণ্ঠে জানা গেছে সেই বর্ণনা। ২০২৪ সালে গাজায় আজুরদের বাড়ি লক্ষ্য করে ইসরায়েলি ড্রোন হামলা চালানো হয়। গাজার পুরোনো একটি শহরে ওই বাড়িতে আজুরের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা।

হামলার মুহূর্তে নিজের বাড়ির চিরচেনা ও নিরাপদ রূপ কীভাবে নিমিষেই বদলে গিয়েছিল সেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আজুর জানায়, বোমা বিস্ফোরণের মুহূর্তে সে প্রাথমিকভাবে তার আহত হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারেনি। প্রথমে সে ভেবেছিল মাটিতে পড়ে গেছে; কিন্তু তার শরীরজুড়ে ভর করেছিল অচেনা কোনো ক্লান্তি, যা কাটিয়ে উঠে দাঁড়ানোর মতো শক্তিও পাচ্ছিল না সে। সেই সময়ের বর্ণনা দিয়ে আজুর বলেছে, ভাবছিলাম, কী হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, তখন আমার এক হাত উড়ে গেছে এবং আরেক হাত উড়ে গিয়ে আমার ডান পাশে এসে পড়ে।

শুধু যে হাত উড়ে গেছে, তা নয়। ড্রোন বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার পুরো শরীর। আর শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যে হাত দুটি সামনে পড়ে ছিল সেগুলোকে পরিচিত মনে হলেও আজুর তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতেই পারেনি, ওই হাত দুটি তার। তাহলে কখন সে বুঝতে পারল পুরো পরিস্থিতি? আজুর জানায়, আহত হওয়ার পর মা বলছিলেন, আমার দুই হাত হারিয়ে গেছে। শুনে আমি কাঁদতে শুরু করি, মনে খুব কষ্ট পাই।

তবে এখানেই কষ্টের শেষ হয়নি। বরং চিকিৎসা নিতে গিয়ে এরচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয় আজুরকে। চিকিৎসাসামগ্রীর চরম সংকটের কারণে অচেতন না করেই অস্ত্রোপচার করা হয় তার। এতে শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি মানসিক অবস্থাও বেশ খারাপ হয়ে যায় তার। আজুরের ভাষায়, চিকিৎসকরা আমাকে জাগিয়ে রেখেই আমার শরীরে অস্ত্রোপচার করেছেন। আমি যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছিলাম না, খুব জোরে চিৎকার করছিলাম। চিৎকারে পুরো হাসপাতাল কেঁপে উঠছিল।

আজুরের চিকিৎসা চলছে এখন কাতারে। সেখানে সে পা দিয়ে লেখা, মোবাইলে গেম খেলা ও পোশাক পরা শিখছে; কিন্তু এখন তাকে নিত্যদিনের বেশিরভাগ কাজের জন্য নির্ভর করতে হয় অন্যের ওপর। অথচ আহত হওয়ার আগে সে নিজেই মা ও অন্যদের কাজে সহায়তা করত। সেসব দিনের কথা মনে করে আজুর বলে, এখন সব কঠিন হয়ে গেছে—নিজে নিজে খাওয়া, শৌচাগারের কাজ সম্পন্ন করা, সবকিছুই। তবে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। এভাবেই আমি জীবন চালাই, নিজেকে সচল রাখি।

এমন পরিস্থিতিতেও আজুর স্বপ্ন দেখে আগামীতে সে তার নিজভূমি গাজায় ফিরে যাবে এবং বিধ্বস্ত অঞ্চল ফের গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। ইসরায়েল তার জন্মভূমি দখল করে নিক, তা চায় না শিশু আজুরও। তবু দ্বিধা কাটে না তার। তাই সরল মনে সে প্রশ্ন তোলে, মানুষ সেখানে মারা যাচ্ছেন। আমাদের বাড়িতেও বোমা হামলা হয়েছে। আমি এভাবে বাঁচব কীভাবে? আজুরের এ প্রশ্নের জবাব দেবে কে!