Image description
রোগী নেই ডিএনসিসি হাসপাতালের আইসিইউতে

কাঁচাবাজারের জন্য তৈরি ডিএনসিসি মার্কেটে ২০১৯ সালে ৭০০ দোকান বিক্রির জন্য বাজেট প্রণয়ন করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এর মাঝেই আসে করোনা। ডিএনসিসি’র নিজস্ব কোনো হাসপাতাল না থাকায় এখানেই হয়ে যায় করোনা আইসোলেশন সেন্টার। পরে ২১২টি পূর্ণাঙ্গ আইসিইউ শয্যা, ২৫০টি এইচডিইউ শয্যা, ৫৩৮টি কোভিড আইসোলেশন কক্ষসহ এটিই হয় দেশের সবচেয়ে বড়  ১০০০ শয্যার করোনা  হাসপাতাল। ২০২৩ সালের ১৯শে এপ্রিল থেকে ডিএনসিসি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি করা হচ্ছে। বড় এ হাসপাতালটি বর্তমানে অনেকটাই সুনশান। সরকারি সম্পত্তি খালি পড়ে আছে। মরণাপন্ন রোগীদের অন্যতম অনুষঙ্গ আইসিইউ শয্যাগুলোর কাজে লাগছে হাতেগোনা কয়েকটি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আইসিউ শয্যা অনেকটা সোনার হরিণ হলেও হাসপাতালটিতে প্রায় ২০০ শয্যাই খালি থাকছে রোজ। 

সরজমিন হাসপাতালের সামনে স্থাপিত হাসপাতালের রোগী-শয্যার তথ্য সংবলিত বোর্ডে দেখা গেছে, তিনদিনে আইসিইউতে রোগী ছিল যথাক্রমে- ১২ জন, ১৬ জন এবং ১১ জন। গত বছরের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে সচল আইসিইউ শয্যার সংখ্যা ১ হাজার ১০১। এর মধ্যে ঢাকায় ৫২৮টি, যার মধ্যে ২১২টিই ডিএনসিসি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে। বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে আইসিইউ শয্যা আছে ১০১টি। এর মধ্যে নবজাতকের আইসিইউ ২০টি ও শিশুদের আইসিইউ ২০টি। ঢাকা মেডিকেল ও সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন একটি আইসিইউ শয্যা পেতে আবেদন জমা পড়ে ৩০ থেকে ৪০টি।    

সরজমিন হাসপাতাল ভবন ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতালের ৬ তলার পুরোটা জুড়ে রয়েছে আইসিইউ। করোনাকালে এখানে আক্রান্ত রোগীদের রাখা হতো। হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিট ঘুরে দেখা যায়, ৬ তলায় আলাদা আলাদা করে ৯টি ইউনিট সাজানো রয়েছে। অল্প কয়েকজন রোগী। ৬ তলার এক কোনায় ৭, ৮ ও ৯নং ইউনিটের আইসিইউগুলো সচল রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃৃপক্ষ জানায়।  সেখানে রোগী, স্বজন ও ডাক্তারদের আনাগোনা রয়েছে। বাদ-বাকি বিশাল জায়গার সবটা জুড়ে বাকি ৬টি ইউনিট, ডাক্তার নার্সদের কক্ষসহ করোনাকালীন সময়ে ব্যবহৃত বিভিন্ন ছোট-বড় কক্ষ তালা দেয়া রয়েছে। সচল ইউনিটের বাইরে বাকি জায়গায় মানুষের চলাচল নেই তেমন, আলো বাতাসের স্বল্পতা ইত্যাদি ওই ফ্লোরকে ভুতুড়ে আবহ দিয়েছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আইসিইউ’র প্রত্যেকটি যন্ত্রপাতি এবং বিছনা রোগী রাখার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। প্রয়োজন পড়লে কেবল ধুয়ে-মুছে শয্যায় তোলা যাবে রোগী। বর্তমানে গুরুতর মহামারি ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগী নেই আইসিইউ শয্যায়। হাঁপানি, ডেঙ্গুসহ ইত্যাদি ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীরা রয়েছেন এখানে। 

হাসপাতাল ভবন ঘুরে আরও দেখা যায়, হাসপাতালের প্রতি ফ্লোরে বেশির ভাগ জায়গাই খালি পড়ে রয়েছে। জায়গার পরিমাণ অনেক বেশি হওয়ায় হাসপাতালকে কেন্দ্র করে এখানে বিভিন্ন বিভাগ ও কক্ষগুলোও একটির সঙ্গে একটির দূরত্ব অনেক বেশি। কেবিন, ওয়ার্ড, ডাক্তারের কক্ষ, ল্যাবরেটরি, ইত্যাদির জন্য খুব কম পরিমাণ জায়গার প্রয়োজন হলেও সীমিত সেবার জন্য বিশাল বিশাল ফ্লোর দখল করে রাখা হয়েছে। বিভিন্ন ফ্লোরের একটি নির্দিষ্ট কোনায় ওয়ার্ডগুলো স্থাপন করা হয়েছে। এক মাথায় ওয়ার্ড থাকলে অন্য মাথাসহ পুরো ফ্লোরটি ফাঁকা পড়ে রয়েছে। কিছু কিছু কক্ষে অনেকগুলো অব্যবহৃত শয্যা পড়ে থাকতে দেখা গেছে। অন্যদিকে, প্রতি তলায় স্থাপন করা দোকানের জন্য নির্ধারিত কক্ষগুলো সাটার বন্ধ, তালা দেয়া। দু-একটা কক্ষে চা বা পানীয়ের দোকান বসানো হয়েছে। করোনার চিকিৎসার জন্য প্রতিটি কক্ষ ও দেয়ালে বিভিন্ন নামে সিলিং করা হয়েছে ওই সকল সিল এবং নামগুলোও কক্ষ ও দেয়াল রয়েছে এখনো। সম্পূর্ণ ভবন ঘুরে দেখা যায়, ভবনের একপাশে কেবিন হলেও অন্যপাশ যেন ভুতুড়ে, অন্ধকার আর জনমানবহীন। খুব অল্প মানুষকে দেখা গেছে হাসপাতালের ভেতরে। 

৬ তলা ভবনের প্রতি তলা ঘুরে দেখা যায়, ভবনের নিচ তলায় রয়েছে বহির্বিভাগ ও ডাক্তারদের কক্ষ। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে শিশুদের ওয়ার্ড ও প্যাথলজি বিভাগ। তৃতীয় তলার এক কোনায় রয়েছে নারীদের ওয়ার্ড। অন্যদিকে পুরুষের ওয়ার্ড রয়েছে চতুর্থ তলার এক কোনায়। পঞ্চম তলার পুরোটাই ফাঁকা পড়ে আছে। ষষ্ঠ তলায় রয়েছে আইসিইউ ইউনিট। এখানের বেশির ভাগ জায়গা জুড়েই আইসিইউ ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে।  

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি এ হাসপাতালের আইসিইউ শয্যাগুলোকে কাজে লাগানো যায় ভিন্নভাবে। দেশের আইসিইউ সেবাকে ঢাকাকেন্দ্রিক না করে বিভাগীয় সরকারি হাসপাতালগুলোতে বাড়ানো যায় আইসিইউ সেবা। এতে রাজধানীকেন্দ্রিক আইসিইউ-নির্ভরতা কমবে। ঢাকা শহরের সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ ইউনিটে চাপ কমবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, ডিএনসিসি’র কেভিড হাসপাতালের যে আইসিইউ শয্যা এগুলো ভিন্নভাবেও কাজে লাগানো যায় এবং এটা আমরা আগেও বলেছি।  

তিনি বলেন, শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক আইসিইউ সেবার কারণে সারা দেশের  মানুষের পাওয়ার সম্ভাবনা একরকম না। ঢাকা থেকে দূরে গেলে আইসিইউ পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। আমরা কেভিডকালীন বা ডেঙ্গুর সময় দেখেছি, ঢাকামুখী আইসিইউ বেশি থাকায় ঢাকার দিকেই মানুষ ছুটে আসে। এতে যে পরিমাণ জীবন বাঁচাতে পারার কথা সে পরিমাণ বাঁচানো যাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে আমরা বলেছি আইসিইউকে একটা ব্যবস্থাপনায় আনার জন্য। 

ডা. বেনজির আহমেদ আরও বলেন, ঢাকা শহরে ২ কোটি মানুষ বাস করে। সে হিসেবে সরকারি মেডিকেল কলেজ আছে হাতেগোনা কয়েকটা। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে ৩ হাজার শয্যা হলে রোগী হয় ১০ হাজার। প্রতিটি মেডিকেলে মোটামুটি একই দশা। সেক্ষেত্রে আরেকটা সরকারি মেডিকেল কলেজ চালু করা যায় তো অবশ্যই ভালো। ডিএনসিসি’র এ হাসপাতালে যেহেতু সবই আছে, এখানে এখন শুধু লোকবল দিতে হবে। ওষুধপত্র, যন্ত্রপাতি সব কিছু মিলিয়ে যে সুযোগ আছে, সেগুলোকে কাজে লাগানো যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য বিভাগ এ জায়গাগুলোতে বেশি মনোযোগ দেয় না। মনোযোগ না দেয়ার ফলে এ সুযোগগুলোকে আমরা কাজে লাগাতে পারি না। যেখানে চিকিৎসার এত চাহিদা, সেখানে এ হাসপাতালটিতে এত কিছু পড়ে আছে, সেগুলোর ব্যবহার হচ্ছে না।         

সার্বিক বিষয়ে কথা হয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি মানবজমিনকে বলেন, ডেঙ্গুর জন্য আমাদের কখনো ২১২টা শয্যার দরকার হয়নি। আমরা আইসিইউ এবং এইচডিইউ মিলিয়ে কাজ করছি। আইসিইউ থেকে রোগীগুলো একটু উন্নতি হলে এইচডিইউতে পাঠিয়ে দিচ্ছি, সেখান থেকেও রোগীগুলো আরেকটু উন্নতি হলে তখন স্বাভাবিক ওয়ার্ডে দিয়ে দিই। আইসিইউ-এইচডিইউ মিলিয়ে ৬০ থেকে ৭০ আসনে হয়ে যায় এখন। আমাদের আইসিইউ আসন আসলেও এখন কমানোও যাচ্ছে না। কারণ আলাদা করে এটার জন্য আমাদের কিছু করাও লাগছে না। কোভিডের সময় যে অবকাঠামো বানানো হয়েছে, সেটা দিয়ে আমাদের হয়ে যাচ্ছে, আমরা শুধু শুধু কমাবো কেন। খালি থাকা এসব আইসিইউ শয্যা সরকারি অন্য কোনো হাসপাতালে দেয়া যায় কিনা বা  অন্য সরকারি হাসপাতালের রোগী রাখা যায় কিনা সে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সে সুযোগ ও নেই। এখানে ক্রিটিক্যাল কেয়ারের ডাক্তার বা এনেস্থেসিওলোজিস্ট নেই। আমাদের এ হাসপাতালে ঢাকার অন্য সরকারি হাসপাতালের মরণাপন্ন রোগীদের রাখার সুযোগ নেই। কারণ এত বেশি সাপোর্ট এখানে নেই। জনবল এবং পর্যাপ্ত সেট-আপ এখানে নেই, তাই এটা সম্ভব না। আমাদের হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগ মোকাবিলার জন্য যে জনবল বা যন্ত্র প্রয়োজন তা আছে। 

ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতাল নিয়ে নতুন পরিকল্পনা ডিএনসিসি’র:  ঢাকা উত্তর সিটির ডেঙ্গুর জন্য বিষেশায়িত এ হাসপাতাল নিয়ে নতুন পরিকল্পনা করছে সিটি করপোরেশন। অনেকটা খালি, বড়  জায়গা, যন্ত্রপাতি যাতে কাজে লাগানো যায় সে বিষয়ে পরিকল্পনা করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ। ডিএনসিসি’র প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এ বিষয়ে মানবজমিনকে বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বিষয়ে পরিকল্পনা চলছে। শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে আমরা কিছু নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র করবো। তখন এ হাসপাতালটি একটি রেফারেল হাসপাতাল হিসেবে কাজ করবে। গ্রামে যেমন উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ইউনিয়ন সেন্টার, কমিউনিটি কেন্দ্র, কমিউনিটি ক্লিনিক থাকে, শহরে এসব নেই। শহরে আছে নগর মাতৃসদন, মাতৃকেন্দ্র। এগুলো একটি প্রকল্পের আওতায় আছে, সে প্রকল্প এ বছর জুনে শেষ হয়ে যাবে। জুলাই থেকে এসব সিটি করপোরেশনের আওতায় চলে আসবে। তখন আমাদের পরিকল্পনা থাকবে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতালটি ডেঙ্গু হাসপাতাল থাকবে, পাশাপাশি অন্যান্য তলায় আমরা এটা একটা রেফারেল হাসপাতাল হিসেবে কাজ করাবো। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও এটা নিয়ে ভাবছে, নগরীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য এটাকে কাজে লাগানো যায় কিনা। তারা আমাদের একটি প্রস্তাবনাও দিয়েছি, সেটা হচ্ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে রেফার্ড হয়ে সে হাসপাতালের চাপ কমানোর জন্য কিছু রোগী এ হাসপাতালে নিয়ে আসা যায় কিনা। কিন্তু এটা আসলে হয়নি বা হবে না। কারণ একটা বড় হাসপাতালে গিয়ে রোগীরা আরেকটা হাসপাতালে আসতে চাইবে না। তারা ঢাকা মেডিকেলের সিঁড়িতেই থাকতে চাইবে। এখানে জায়গা আছে অনেক সুন্দর। আমাদের পরিকল্পনা আছে জুনের পর এ হাসপাতালকে একটি রেফারেল হাসপাতাল হিসেবে পরিণত করবো।