
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আট মাস পেরিয়ে গেলেও চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই দিনাতিপাত করছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। সহসা এ পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার কোনো আশাও তাদের সামনে নেই।
কত দিনে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন—তা নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত, দিশাহীন হয়ে পড়েছেন আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীরা।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। ওই দিন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে পালিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা। বর্তমানে তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন। শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরা দ্রুত আত্মগোপনে চলে যান। দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা, সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-এমপিদের অনেকেই বিভিন্নভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে বিদেশে চলে গেছেন। কেউ কেউ ৫ আগস্টের আগেই দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমান। নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে চলে যাওয়ার পর অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে ঐতিহ্যবাহী দলটি। এখন পর্যন্ত সেই অবস্থাতেই রয়েছে।
বিদেশে পাড়ি জমানো আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ কেউ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, বেলজিয়াম, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। তবে অধিকাংশ নেতাই রয়েছেন ভারতে। তারা দিল্লি, কলকাতা, শিলং, আগরতলা, শিলিগুড়িসহ ভারতের বিভিন্ন শহরে আশ্রয় নিয়েছেন। ভারতে পালিয়ে যাওয়া নেতাকর্মীদের মধ্যে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের লোকজনও রয়েছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে দেশে যারা আত্মগোপনে আছেন, তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ হঠাৎ কোনো কোনো জায়গায় দুই-একটি ঝটিকা মিছিল বের করেছেন। সবশেষ গত ৬ এপ্রিল সকালে বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেট থেকে শহীদ আবরার ফাহাদ অ্যাভিনিউয়ে (সাবেক বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ) আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় পর্যন্ত দলটির কয়েকজন নেতাকর্মী ঝটিকা মিছিল করেন। এর আগে ২১ মার্চ সন্ধ্যায় ধানমন্ডি ২৭ নম্বর থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা একটি মিছিল বের করেন। ওই মিছিল থেকে তিনজনকে আটক করা হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দিয়ে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা অত্যন্ত অসহায় ও নিরাপত্তাহীন এবং অধিকাংশ সময়ই পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। এমনকি অনেকে ৫ আগস্টের পর থেকে আজ পর্যন্ত বাড়িতে আসতে পারেননি বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। ঈদের সময়েও অনেকে নিজ বাড়ি যেতে এবং স্বজনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে পারেননি।
সরকার পতনের পর দলের সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলের কেন্দ্র থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর হাজার হাজার নেতাকর্মীর নামে মামলা হয়েছে। শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যায়ের অনেক নেতা, সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানান, এখনও অনেকের নামে মামলা হচ্ছে এবং গ্রেপ্তার অব্যাহত আছে। শেখ হাসিনার নামে এখন পর্যন্ত প্রায় আড়াইশ’ মামলা হয়েছে। শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের কারো কারো নামে অর্ধশতাধিক মামলা রয়েছে। তৃণমূলের বিভিন্ন পর্যায়ের যেসব নেতাকর্মীর নামে মামলা হয়েছে, তাদের অর্ধিকাংশের একাধিক, কারো কারো নামে চার-পাঁচটি করে মামলা হয়েছে।
এদিকে কতজন নেতাকর্মী এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন, আওয়ামী লীগের কাছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য বা হিসাব নেই। দলটির একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, ১৫ হাজারের বেশি নেতাকর্মী কারাগারে রয়েছেন। তবে নেতাদের কারো কারো মতে গ্রেপ্তার নেতাকর্মীর সংখ্যা আরও অনেক বেশি। তবে সঠিক হিসাব নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানান, দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকা অনেক নেতাকর্মী জীবিকার প্রয়োজনে নিরুপায় হয়ে পড়েছেন। কিন্তু প্রকাশ্যেও আসতে পারছেন না। প্রকাশ্যে এলেই হামলা হতে পারে, এই ভয়ে এখনও আত্মগোপনে থেকে কষ্টের দিন কাটাচ্ছেন। নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঝুঁকি এখনও কাটেনি, বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি আদালত থেকে জামিনের পর সিরাজগঞ্জের এমপি আব্দুল আজিজের ওপর হামলার ঘটনার কথা তারা উল্লেখ করেন। আবার প্রায় প্রত্যেকের নামেই একাধিক মামলা রয়েছে। অনেক মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছে। অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে গ্রেপ্তারের ভয়েও আছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
তাই পরিস্থিতি যত করুণই হোক গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে থাকতেই বাধ্য হচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আরও কতদিন এভাবে চলবে, তা জানেন না তারা। সহসা সংকট কাটবে, এমন আশাও করতে পারছেন না। এমন কঠিন করুণ পরিস্থিতিতে হতাশ হয়ে পড়েছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অজ্ঞাত স্থানে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, দলের শীর্ষ পর্যায়ের দুই-একজন নেতা কখনও কখনও হোয়াটসঅ্যাপ ও মেসেঞ্জারের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন। কিন্তু তারাও সুনির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা দিতে পারছেন না। সংকট কত দিনে কাটবে, তারা সে বিষয়ে কিছুই বলতে পারেন না!
বিপদগ্রস্ত নেতার্মীদের অনেকে তাদের করুণ পরিস্থিতির জন্য দলের প্রভাবশালী নেতাদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে যারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে বিদেশে চলে গেছেন এবং তারা স্বাচ্ছন্দ্যে আছেন বলে বিপদে থাকা তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কেউ কেউ মনে করছেন। কোনো কোনো নেতা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দিয়ে তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে মাঝে মাঝে যোগাযোগ, খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করলেও অনেকেই কর্মীদের কোনো খোঁজ-খবর রাখেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে। এসব কারণে অনেকেই নেতাদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছেন।
আবার অনেকে নেতাদের ওপর পুরনো ক্ষোভও ঝাড়ছেন। তাদের অভিযোগ, ক্ষমতায় থেকে অনেক নেতাই তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বিপদের সময় পাশে থাকেনি, সহযোগিতা চেয়েও পাওয়া যায়নি। ক্ষমতায় থাকাকালেই তাদের এই আচরণ লক্ষ্য করা গেছে আর এখন তো প্রতিকূল পরিস্থিতি! এ অবস্থায় তারা নিজেদের বিপদের কথাই বড় করে বলবেন। এখন তো সব পর্যায়ের নেতারাকর্মীরাই বিপদে আছেন। তাই কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখার সহজ যুক্তি দেখাতে পারবেন নেতারা।
অজ্ঞাত স্থানে আত্মগোপনে থাকা তৃণমূল পর্যায়ের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাবেক এক এমপির (তিনি একবার প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন) বিরুদ্ধে অভিযোগ ও তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আওয়ামী লীগের স্থানীয় এক নেতা দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। টাকার অভাবে ঠিক মতো চিকিৎসা করাতে না পেরে তার অকাল মৃত্যু হয়। অথচ এমপিকে কত বার অনুরোধ করা হয়েছে ওই নেতার চিৎসার ব্যাপারে। কিন্তু তিনি কোনো খবরই নেননি। আর এখন তো নিজের সমস্যা সামলাতেই ব্যস্ত!
যদিও দলের পক্ষ থেকে তৃণমূল নেতাকর্মীদের খোঁজ-খবর নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে এক নির্দেশনায় দলের প্রতিটি নেতাকর্মীর খোঁজ-খবর এবং তথ্য সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। এসব তথ্য সংগ্রহ করে দলের ইমেইল ও টেলিগ্রামে পাঠাতে বলা হয়েছে। জানতে চাওয়া তথ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে—কতজন দলীয় নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন, তাদের পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ আছে কি না, জেলায় মোট কতগুলো মামলা হয়েছে—এর মধ্যে জিআর, সিআর ও আইসিটি মামলার সংখ্যা কত, কতজন নেতাকর্মী কারাগারে আছেন, আহত নেতাকর্মীর সংখ্যা কত, তারা কোথায় চিকিৎসা নিচ্ছেন, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং নিজ আসনের সংসদ সদস্যদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সর্বশেষ আপডেট কী ইত্যাদি বিষয়।