
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০২৩ সালের নীতিমালা বাদ দিয়ে ‘একই আদলে’ নতুন পর্যবেক্ষক নীতিমালা করা হচ্ছে।
সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে দেশিয় পর্যবেক্ষকদের জন্য এইচএসসি বা সমমানের শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করতে দিতে চায় নির্বাচন কমিশন।
সেই সঙ্গে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০২৩ সালের নীতিমালা বাদ দিয়ে ‘একই আদলে’ নতুন পর্যবেক্ষক নীতিমালা করা হচ্ছে।
বর্তমানে ৯৬টি পর্যবেক্ষক সংস্থা নিবন্ধিত রয়েছে ইসিতে। এগুলোর নিবন্ধনও বাতিল হয়ে যাবে, আগ্রহী সংস্থাগুলোকে নতুন নীতিমালার আলোকে আবেদন করতে হবে।
সবশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সংস্থাগুলোর ২০ হাজারেরও বেশি পর্যবেক্ষক ছিল; নীতিমালা অনুযায়ী এসএসসি বা সমমান পাস করলেই পর্যবেক্ষক হওয়ার সুযোগ ছিল।
গত তিনটি নির্বাচনে সংস্থা ও পর্যবেক্ষকদের সংখ্যা কম থাকলেও নবম সংসদ নির্বাচনে দেড় লাখেরও বেশি এবং অষ্টম সংসদ নির্বাচনে দুই লাখেরও বেশি পর্যবেক্ষক ছিল ৩০০ আসনে।
নতুন নীতিমালার খসড়ার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পর্যবেক্ষক নীতিমালায় মূলত শিক্ষাগত যোগ্যতার একটি বিষয় এসেছে। আগে এসএসসি পাস ছিল, এবার পর্যবেক্ষক হতে এইচএসসি পাস হতে হবে। একটা লেভেল মেনটেইন করার জন্য এটা নির্ধারণের পক্ষে মত দেওয়া হয়েছে।”

নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলছেন, নিবন্ধিত অনেক সংস্থার ব্যাপারে বিতর্ক ওঠায় পর্যবেক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পরিমার্জন ও পরিবর্তন প্রয়োজন।
এ নির্বাচন কমিশনারের ভাষ্য, “ভোটকেন্দ্র পর্যবেক্ষণ যিনি করবেন তার একাডেমিক যোগ্যতা মিনিমাম লেভেলে না থাকলে তো হবে না। কাউকে খাটো করার জন্য নয়। একাডেমিক কোয়ালিফিকেশন মিনিমাম থাকলে ভালো হয়, আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা ভালো হয়।”
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক বিষয়ে সুপারিশ করেছে সরকারের কাছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকেও পর্যবেক্ষণ নীতিমালাসহ ৯টি বিষয়ে ‘অতি জররি ভিত্তিতে’ প্রস্তাব চেয়ে ইসি সচিবকে চিঠি দিয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের মতামত নিয়ে এপ্রিলের শুরুতে সার্বিক বিষয়ে সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানোর কথা রয়েছে।
ইসির উদ্যোগ
দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন ও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে ৬ জন কর্মকর্তাকে নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে গেল জানুয়ারিতে।
>> ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৪০টি পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠানের ৫১৭ জন এবং স্থানীয়ভাবে ৮৪টি পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠানের ২০ হাজার ২৫৬ জনকে ভোট পর্যবেক্ষণের অনুমোদন দেওয়া হয়।
>> ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে ৮১টি দেশি পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠানের ২৫ হাজার ৯০০ জন প্রতিনিধি। এছাড়া ৩৮ জন (ফেমবোসা, এএইএ, ওআইসি ও কমনওয়েলথ থেকে আমন্ত্রিত) বিদেশি পর্যবেক্ষক, বিভিন্ন বিদেশি মিশনের ৬৪ জন কর্মকর্তা এবং দূতাবাস ও বিদেশি সংস্থায় কর্মরত ৬১ জন ভোট পর্যবেক্ষণ করেন।
>> ২০১৮ ও ২০১৪ সালে একাদশ ও দশম সংসদ নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্র পর্যবেক্ষক পাঠায়নি। পরে এ দুটি নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নও তুলেছিল তারা।
>> দশম সংসদ নির্বাচনে সব দল অংশ না নেওয়ায় পর্যবেক্ষকও কম ছিল। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ওই নির্বাচনে মাত্র চারজন বিদেশি এবং স্থানীয় ৩৫টি সংস্থার ৮ হাজার ৮৭৪ জন ভোট পর্যবেক্ষণ করেন।
>> ২০০৮ সালে ৫৯৩ জন বিদেশি এবং ১ লাখ ৫৯ হাজার ১১৩ জন দেশি ভোট পর্যবেক্ষণ করেন।
|
ইতোমধ্যে এ কমিটি প্রস্তাবিত নীতিমালা তৈরি করে বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করেছে বলে জানিয়েছেন ইসির যুগ্মসচিব ইটিআই মহাপরিচালক এসএম আসাদুজ্জামান।

নির্বাচন পর্যবেক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেছেন, ইসি কমিটির পর্যালোচনায় গেল নির্বাচনের সময় নিবন্ধন পাওয়া অনেক সংস্থার ব্যাপারে বিতর্ক উঠেছে; পর্যবেক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় শুদ্ধিকরণ জরুরি। কিছু পরিমার্জন ও পরিবর্তন করা প্রয়োজন।
ইসি কমিটির পরামর্শে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০২৩ সালে করা নীতিমালা বাদ দিয়ে নতুন নীতিমালা করা হবে। ওই সময়ে পাওয়া দেশি সংস্থার নিবন্ধনও স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে।
“পর্যবেক্ষক হতে নতুন শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি যুক্ত করা হচ্ছে। বাকি সব আগের নীতিমালার মতোই নতুন পর্যবেক্ষক নীতিমালা করা হবে; সে অনুযায়ী সব সংস্থা নিবন্ধনের জন্য আবেদন করবে। যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শেষে ৫ বছরের জন্য নিবন্ধন দেওয়া হবে,” বলেন আনোয়ারুল ইসলাম সরকার।
নাম সর্বস্ব, ভুঁইফোড় কোনো সংস্থা বা ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর সঙ্গে পর্যবেক্ষকদের ব্যক্তিগত স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে সে বিষয়গুলোতে নজর রাখবে ইসি।

পর্যবেক্ষকদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক করার পক্ষে জানিপপ চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ নীতিমালায় তেমন কোনো পরিবর্তনের প্রস্তাব না থাকায় তা আগের মতোই থাকছে।
যা বলছেন পর্যবেক্ষকরা
পর্যবেক্ষকদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা এইএচএসসি করার উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন পর্যবেক্ষকরা।
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ-জানিপপ চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, “পর্যবেক্ষকদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক করলে আরও ভালো হতো। আমরা সব সময় আন্তর্জাতিক মানের পর্যবেক্ষক চাই। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ একটা দক্ষতার বিষয়। পাশাপাশি স্টেশনারি বা একটা কেন্দ্রেই পর্যবেক্ষক না থেকে ভ্রাম্যমাণ টিম রাখতে হবে।”
নতুন করে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে পর্যবেক্ষক সংস্থা আহ্বান করাটাই ভালো হবে বলে মত দেন তিনি।

ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্স (ফেমা) প্রেসিডেন্ট মুনিরা খানের মতে, পর্যবেক্ষকদের প্রশিক্ষণটা বেশি জরুরি।
“আমরা যারা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি তাদের প্রশিক্ষিত, দক্ষ লোকবল রয়েছে। আবার ভোটের সময় কিছু ভুঁইফোড় সংস্থাও চলে আসে, বিশেষ কোনো মোটিভও থাকতে পারে। আবার কারো কাছে এটা মৌসুমী ব্যবসার মতো, কিছু ভ্রান্ত ধারণা নিয়েও আসে। এজন্য আন্তর্জাতিক মানের স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের তৈরি হতে হবে,” বলেন জানিপপ চেয়াম্যান।
ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্স (ফেমা) প্রেসিডেন্ট ও সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) চেয়ারম্যান মুনিরা খান বলেন, “পর্যবেক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক করা গেলে আরও ভালো হতো। প্রশিক্ষণটা বেশি জরুরি পর্যবেক্ষকদের। তারা কোথাও কথা বলতে পারবে না, বক্তব্য-মন্তব্য দেওয়ার সুযোগ নেই। আন্তর্জাতিক মান মেনে স্থানীয় পর্যবেক্ষকরা শুধু পর্যবেক্ষণে করবে আর রিপোর্ট করবে- এ বিষয়টাই মাথায় রাখতে হবে।”