Image description

চলমান গ্যাসসংকটসহ নানা কারণে ক্ষতির মুখে রয়েছে দেশের শিল্প খাত। দীর্ঘদিন ধরেই চাহিদামতো গ্যাস মিলছে না শিল্প-কারখানাগুলোতে। গ্যাসসংকটের কারণে তাদের উৎপাদন ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। শিল্প-কারখানার পাশাপাশি সিএনজি স্টেশন, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও আবাসিক খাতসহ সব ক্ষেত্রে এখন গ্যাসের সংকট চলছে।

এমন পরিস্থির মধ্যেই নতুন শিল্প-কারখানায় এবং ক্যাপটিভ পাওয়ারে (শিল্পে উৎপাদিত নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র) গ্যাসের দাম আরো ৩৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে শিল্প গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের বিল ৩০ টাকা থেকে বেড়ে ৪০ টাকা এবং ক্যাপটিভ গ্যাসের দাম ৩১.৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪২ টাকা করা হয়েছে। এই অবস্থার মধ্যেই নতুন করে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি শিল্পে নতুন বিনিয়োগে বাধাগ্রস্ত করাসহ শিল্পের সংকট আরো বাড়িয়ে তুলবে বলে শিল্পের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন।

শিল্পে বাড়তি ব্যয়ের বোঝাখাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা, বাজার অস্থিতিশীলতা, ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার, ঋণপত্র খোলার অভাবে কাঁচামালের অপর্যাপ্ততা, শ্রমিক অসন্তোষ ও উৎপাদন অপ্রতুলতায় প্রায় দুই শতাধিক কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।

যেগুলো টিকে আছে সেগুলোও অস্তিত্বের সংকটে ধুঁকছে। এমতাবস্থায় নতুন করে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে শিল্প খাতকে আরো ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে জানিয়েছেন তাঁরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার গ্যাসের দাম বাড়ালেও সরবরাহ তেমন বাড়াতে পারবে না। কারণ ধারাবাহিকভাবে দেশীয় কূপগুলো থেকে গ্যাসের উৎপাদন কমে আসছে।

তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) থেকে সর্বোচ্চ আমদানির সক্ষমতা ১১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। নতুন এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ না হলে আমদানি আর বাড়ানো যাবে না। আগামী দুই বছরেও নতুন টার্মিনাল চালুর তেমন সম্ভাবনা নেই। টার্মিনাল নির্মাণে কোনো চুক্তি হয়নি। আওয়ামী লীগ আমলে হওয়া দুটি চুক্তি বাতিল করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

তাই যেভাবেই হোক অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে শিল্পে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর জোরালো উদ্যোগ নেওয়ার পরমার্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে প্রায় চার হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। গতকাল রবিবার গ্যাস সরবরাহ করা হয় দুই হাজার ৬৯৬ মিলিয়ন ঘনফুট। এতে গতকাল ঘাটতি ছিল প্রায় দেড় হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। মোট দুই হাজার ৬৯৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের মধ্যে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে এক হাজার ৮৭৩ মিলিয়ন ঘনফুট এবং আমদানীকৃত তরলীকৃত প্রকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) থেকে ৮২২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। 

ঢাকার সাভার, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদী এলাকার শিল্প-কারখানাগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না পাওয়ায় উৎপাদন ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। গ্যাসের চাপ কম থাকায় এসব এলাকার বেশ কিছু শিল্প-কারখানা কখনো চলছে, কখনো বন্ধ থাকছে। গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনের নিজস্ব ব্যবস্থা থাকলেও গ্যাসের সংকটে শিল্প-কারখানাগুলো সেগুলোও চালাতে পারছে না। এতে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছেন শিল্পোদ্যোক্তারা।

রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের এক শীর্ষস্থানীয় উদ্যোক্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, এমনিতেই আগে থেকেই শিল্পে গ্যাসের দাম বেশি। তার পরও তা ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না, কারখানা চালানোও যাচ্ছে না। এ ছাড়া উচ্চ সুদহার, ডলারের সঙ্গে টাকার অবমূল্যায়ন ও ডলারসংকটসহ নানা সমস্যা ব্যবসায় খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ উৎপাদিত পণ্যের রপ্তানি পর্যায়ে দাম বাড়েনি। ব্যবসায়ীদের যখন চরম সংকটের মুখে টিকে থাকাই দায়, তখনই নতুন করে আবার গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা ব্যবসায়ীদের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, নতুন শিল্পের জন্য গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে নতুন করে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে না এবং বিনিয়োগও হবে না। যদি কেউ মনে করে প্রতি ঘনফুট গ্যাস ৪০ থেকে ৪২ টাকা দিয়ে ব্যবহার করে নতুন শিল্প চালাতে পারবে, তারাই শিল্প-কারখানা করবে। তবে আমার ধারণা, নতুন শিল্পের জন্য এত উচ্চমূল্যের গ্যাস বিল দিয়ে কেউ এই খাতে বিনিয়োগ করবে না। পাশাপাশি আমরা যারা কারখানা চালাচ্ছি, তারাও সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগী হবো না। তিনি আরো বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানো হলেও গ্যাসের সরবরাহ কিন্তু বাড়ানো হচ্ছে না। বর্তমানে চাহিদার তুলনায় অনেক কম গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে, এতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

উদ্যোক্তারা বলছেন, নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে শিল্পের গ্যাসের দাম ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। শিল্প ও ক্যাপটিভে প্রতি ইউনিটের দাম করা হয় ৩০ টাকা। পরে গত বছর ক্যাপটিভে দাম বাড়িয়ে করা হয় ৩১ টাকা ৫০ পয়সা। কিন্তু এখন পর্যন্ত শিল্পে গ্যাস সংকট কাটেনি; বরং গ্যাসসংকটে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এই সংকটের মধ্যে গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বাড়ানোর কারণে এই খাতে বিনিয়োগ পুরো বন্ধ হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সভাপতি মইনুল ইসলাম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, গ্যাসের এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশে গ্যাসভিত্তিক শিল্পের বিকাশ হবে না। ঋণখেলাপির সংখ্যা বাড়বে। শিল্প বাঁচাতে সিরামিক শিল্পে সরকারি ভর্তুকি দিতে হবে, করের হার হ্রাস করতে হবে এবং রপ্তানিতে প্রণোদনা বাড়ানোর প্রয়োজন। যদি সঠিক সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয় তবে কার্পেট, চিনি, কাগজ ইত্যাদি শিল্পের মতো সিরামিক শিল্প রূগ্ণ কারখানায় পরিণত হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য যা যা সুবিধা দেওয়া হবে, আমরা কেন সেটা পাব না, তা আমার বোধগম্য হয় না। আশা করি শিল্প ও বাণিজ্য উপদেষ্টা এই শিল্প টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম কালের কণ্ঠকে বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরও যদি শিল্পে বাড়তি গ্যাসের সরবরাহ দিতে না পারে তাহলে উদ্যোক্তাদের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়াবে। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি এলএনজি আমদানির সক্ষমতা বাড়াতে হবে, যদিও ২০২৬ সালের আগে এলএনজির সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। 

গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বাড়ল

শিল্প সংযোগে গ্যাসের দাম ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪০ টাকা এবং ক্যাপটিভ গ্যাসের ৩১ টাকা ৫০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪২ টাকা করা হয়। পুরনো শিল্পকারখানায় অনুমোদিত লোডের বাইরে অতিরিক্ত ব্যবহারে দিতে হবে বাড়তি দাম। প্রতিশ্রুত শিল্প গ্রাহকদের অনুমোদিত লোডের ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহারে বাড়তি দাম দিতে হবে। নতুন এ দাম গতকাল রবিবার থেকেই কার্যকর হয়।

গতকাল সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সংবাদ সম্মেলনে গ্যাসের নতুন দাম ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। সংবাদ সম্মেলনে বিইআরসি চেয়ারম্যান জালাল আহমেদসহ আরো উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য মিজানুর রহমান, সদস্য সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া, আব্দুর রাজ্জাক ও শাহীদ সারোয়ার। বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, দেশের গ্যাস কমার সঙ্গে সঙ্গে এলএনজি আমদানি বাড়তে থাকে। এলএনজির বাড়তি দাম দিতে গিয়ে চাপে পড়ে পেট্রোবাংলা। তারা ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছিল। তবে গণশুনানিতে বেশির ভাগ অংশগ্রহণকারী দাম বাড়ানো নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল। বিইআরসির চেয়ারম্যান বলেন, রাজস্ব চাহিদা ধরলে দাম অনেক বেশি বাড়াতে হতো। তাই ভোক্তার জন্য সহনীয় রাখতে ৩৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভর্তুকিরও হিসাব করা হয়নি।

বিইআরসির আদেশ বলছে, ১৩ এপ্রিল এর পরে যত গ্যাস সংযোগ অনুমোদন করা হবে, তাদের বাড়তি দাম দিতে হবে। এর আগপর্যন্ত যেসব সংযোগ আবেদনের চাহিদাপত্র ইস্যু করা হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহারে নতুন দাম। আর পুরনো শিল্প গ্রাহকরা অনুমোদিত লোডের বাইরে যতটুকু ব্যবহার করবেন, ততটুকুর নতুন দাম দিতে হবে। এর আগে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে শিল্পে ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয় শিল্পে গ্যাসের দাম। শিল্প ও ক্যাপটিভে প্রতি ইউনিটের দাম করা হয় ৩০ টাকা। পরে গত বছর ক্যাপটিভে দাম বাড়িয়ে করা হয় ৩১ টাকা ৫০ পয়সা।

এদিকে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি গণশুনানি করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। নতুন শিল্পের জন্য ১৫২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে প্রতি ঘনমিটার গ্যামের দাম ৭৫.৭২ টাকা করার প্রস্তাবের ওপর শুনানি গ্রহণ করা হয়েছিল। শুনানিতে উপস্থিত থেকে শিল্পের উদ্যোক্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, শিল্পে নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব অযৌক্তিক-অবাস্তব একটি সিদ্ধান্ত। এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকতে বিইআরসিকে আহ্বান জানান তারা। শিল্প-কারখানার উদ্যোক্তারা বলছেন, এই অবস্থায় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করা হলে বাংলাদেশে আর কোনো শিল্প-কলকারখানা গড়ে উঠবে না। টিকবে না শিল্প খাত।