
বিদেশে বসে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসররা দেশে জুলাই গণহত্যার তদন্ত ও বিচার বানচালে নানাভাবে ষড়যন্ত্র করছে। এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে তারা বিদেশে নিয়োগ করেছে লবিস্ট ফার্ম। বিচার ঠেকাতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং প্রসিকিউশন টিমের ওপরে সরাসরি প্রাণঘাতী বোমা হামলার চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ পরিকল্পিতভাবে চালানো হচ্ছে অপপ্রচার। ষড়যন্ত্রকারী ও পলাতক খুনিদের দেশে ফেরাতে ইন্টারপোলের সহায়তা চেয়েছে প্রসিকিউশন। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের বানোয়াট অভিযোগ আনার লক্ষ্যে বিপুল অর্থ ব্যয়ে ব্রিটেনের বিখ্যাত ল’ ফার্ম ডাউটি স্ট্রিট চেম্বার্সকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটার)-এ সমন্বিত এবং পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এভাবে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের পলাতক সুবিধাভোগীরা বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে তদন্ত কার্যক্রম এবং বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিতভাবে তদন্ত কার্যক্রম এবং প্রসিকিউটরদের সম্পর্কে গুজব ও ভুল তথ্য ছড়ানোর মাধ্যমে বা মিথ্যা অপবাদ প্রদান করে জনমনে এবং শহিদ পরিবারদের বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করে প্রসিকিউশন।
এর আগে গত ৮ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ৬২ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অভিযোগ করেন লন্ডনে অবস্থানরত সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক আদালতে এই অভিযোগ করা হয়। এই অভিযোগের কোনো সাড়া না পেয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নতুন করে বিপুল অর্থ ব্যয় করে ব্রিটেনের বিখ্যাত ল’ ফার্ম ডাউটি স্ট্রিট চেম্বার্সকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর অভিযোগ আনার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয়ে যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত আইনজীবী ফার্ম ডাউটি স্ট্রিট চেম্বার্সকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিতভাবে তদন্ত কার্যক্রম ও প্রসিকিউটরদের সম্পর্কে গুজব, ভুল তথ্য, মিথ্যা অপবাদ ছড়িয়ে জনমনে, বিশেষ করে জুলাই শহিদ পরিবারের সদস্যদের বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে শেখ হাসিনাসহ পলাতকদের ফেরাতে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে ‘রেড নোটিশ’ জারির জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ‘আয়নাঘর’ নামে কুখ্যাতি পাওয়া গোপন বন্দিশালায় বোমা রাখা হয়েছিল। পাঁচটি বোমার সঙ্গে টাইমার সেট করা ছিল। সেগুলো বিস্ফোরিত হলে পুরো ভবনটি উড়ে যেত। তদন্ত কাজে নানাভাবে বাধা দেওয়া হচ্ছে। শত বাধা উপেক্ষা করে প্রসিকিউশন কাজ করে যাচ্ছে।
জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রসিকিউটর মনোওয়ার হোসেন তামিম রোববার যুগান্তরকে জানান, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধন করা হয়েছে। এতে ১১ নম্বর ধারায় একটি নতুন উপধারা যুক্ত করা হয়েছে। নতুন যুক্ত (৯) উপধারায় বলা হচ্ছে, ট্রাইব্যুনাল আসামির সম্পদ অবরুদ্ধ বা জব্দের আদেশ দিতে পারবেন। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য সেসব সম্পদ ভিকটিমদের (ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি) ক্ষতিপূরণ হিসাবে বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত দিতে পারবে।
৩৩০টি অভিযোগ দায়ের : প্রতিবেদনে উঠে এসেছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চিত্র। এতে বলা হয়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দেড়-দুই হাজারের বেশি মানুষ শহিদ হয়েছেন। ২৫ হাজারের মতো ছাত্র-জনতা আহত হয়েছেন। এসব ঘটনার জলজ্যান্ত প্রমাণ রয়েছে। ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশন সেটা প্রমাণ করতে সক্ষম হবে এবং আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখেই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে। প্রসিকিউশনের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মোট ৩৩০টি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। যেখানে ৩৯টি তদন্ত কার্যক্রম (কমপ্লেইন্ট রেজিস্টার অনুসারে) চলমান। তদন্তের প্রাথমিক সত্যতার আলোকে মিস কেস হয়েছে ২২টি। এসব মিস কেসে সর্বমোট অভিযুক্ত ব্যক্তি ১৪১ জন। এর মধ্যে গ্রেফতার রয়েছেন ৫৪ জন, আর ওয়ারেন্টভুক্ত পলাতক ৮৭ জন। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বেসামরিক ব্যক্তি হচ্ছেন ৭০ জন, পুলিশ ৬২ জন, আর সামরিক হচ্ছেন ৯ জন।
প্রতিবেদনে প্রসিকিউশন জানায়, আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানো, চানখাঁরপুল হত্যাকাণ্ড, রামপুরা কার্নিশে ঝুলে থাকা ব্যক্তিকে গুলির প্রেক্ষিতে করা শেখ হাসিনার মামলার তদন্ত শেষ বা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিমে চিফ প্রসিকিউটরসহ মোট ১৭ জন প্রসিকিউটর রয়েছেন। আর ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় মোট তদন্তকারী কর্মকর্তার সংখ্যা বর্তমানে ২৪ জন। তদন্ত সংস্থার সব সদস্যই পুলিশ বাহিনী থেকে প্রেষণে বা চুক্তিভিত্তিক হিসাবে নিযুক্ত হয়েছেন।
তদন্ত কার্যক্রম : প্রতিবেদনে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কার্যক্রমের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এ যাবৎ সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে ১০০০ জনের ওপরে। ১৫টি জেলায় তদন্তের জন্য একাধিকবার পরিদর্শন করা হয়েছে। গুমবিষয়ক তদন্ত কার্যক্রমে ঢাকা শহরের ৩টি এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও বগুড়া জেলায় ৩টি গুমের কেন্দ্র পরিদর্শন ও সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। তদন্ত কাজে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়-মাদ্রাসা পর্যায়ে এ পর্যন্ত গণশুনানি গ্রহণ করা হয়েছে ৪টি। এতে মোট অংশগ্রহণ ৮ শতাধিক শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও সাধারণ মানুষের।
তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়া : প্রতিবেদনে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, যে কোনো ভুক্তভোগী তদন্ত সংস্থা কিংবা চিফ প্রসিকিউটর বরাবর অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন। চিফ প্রসিকিউটরের কাছে দাখিলকৃত অভিযোগ পরবর্তীকালে তদন্ত সংস্থায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে। প্রাপ্ত অভিযোগ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা প্রাথমিকভাবে যাচাই-বাছাই করে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করবেন। তদন্ত কর্মকর্তা তদন্তের প্রেক্ষিতে আসামি গ্রেফতারের জন্য ওয়ারেন্ট চাইতে পারেন। গ্রেফতারকৃত আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ, সাক্ষ্যপ্রমাণ সংরক্ষণ বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য অনুমতি চাইতে পারেন। এক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালে একটি ‘মিস কেস’ চালু হয়। তদন্ত সম্পন্ন হওয়ার পর তদন্ত কর্মকর্তা চিফ প্রসিকিউটর বরাবর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবেন। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর চিফ প্রসিকিউটর ফরমাল চার্জ প্রস্তুত করে তা ট্রাইব্যুনালে দাখিল করবেন। ট্রাইব্যুনাল ফরমাল চার্জ গ্রহণ করার পরে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করার মাধ্যমে বিচারিক কার্যক্রম শুরু করবেন। যেসব আসামি গ্রেফতার আছেন, তাদের আইনজীবীদের প্রস্তুতির জন্য নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হবে। প্রসিকিউশনের ওপেনিং স্টেটমেন্টের মাধ্যমে মূল কার্যক্রম শুরু হবে।
গত জুলাই-আগস্টে গড়ে ওঠা ছাত্র-জনতার আন্দোলন নির্মূলে আওয়ামী লীগ সরকার ও তার অনুগত প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করে ৫ আগস্ট দেশ ত্যাগ করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে টানা প্রায় ১৬ বছরের শাসনের অবসান হয়। এসব অপরাধের বিচার চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। গত ১৭ অক্টোবর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়।