
গত বছরের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর সারা দেশের অধিকাংশ দেওয়াল, পিলার রাঙানো হয় শিক্ষার্থীদের আঁকা গ্রাফিতিতে। আবেগ, দেশপ্রেম, সৌহার্দ-সম্প্রীতির বার্তা দেওয়া এসব গ্রাফিতি দেশ-বিদেশে সাড়া ফেলে। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে আঁকা এমন অসংখ্য গ্রাফিতি ঢাকা পড়েছে রাজনৈতিক নেতাদের পোস্টারে।
এই আন্দোলন শুরু থেকে ছিল শিক্ষার্থীদের। পরে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্নভাবে যুক্ত হয় এবং সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে দেশ ফ্যাসিবাদমুক্ত হলেও দেওয়ালে আঁকা শিক্ষার্থীদের আবেগ মুছতে সাত মাসও সময় নিলেন না রাজনৈতিক নেতারা। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও নেতাদের পোস্টারে ঢাকা পড়েছে গ্রাফিতিতে আঁকা জাতীয় পতাকা, ঢেকেছে জুলাই আন্দোলনের শহীদ আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ওয়াসিমের মুখও।
১১ এপ্রিল কনসার্ট শেষ হলে আমরা ম্যাসিভ আকারে নগরীতে যত্রতত্র সাঁটানো ব্যানার-পোস্টার অপসারণ করবো। জুলাই আন্দোলনের গ্রাফিতির ওপর পোস্টার লাগানো হলে তাও অপসারণ করা হবে।- চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন
সরেজমিনে দেখা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরীর লালখানবাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত নির্মিত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পিলারে আঁকা গ্রাফিতিগুলোর বেশিরভাগ ঢাকা পড়েছে পোস্টারে। পাশাপাশি নগরীর অনেক স্থানে আঁকা গ্রাফিতির চিত্রও একই। কোথাও আবার কালি লেপ্টে বিকৃতি করা হয়েছে গ্রাফিতির দৃশ্য। এতে গ্রাফিতিগুলোতে লেখা স্লোগান বিকৃত হয়ে গেছে। অনেক স্থানে বিএনপি, জাতীয় পার্টির অঙ্গসংগঠনের নেতারা তাদের পোস্টার লাগিয়েছেন। পরিচিত শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে অনেক উঠতি নেতার পোস্টারও লেগেছে জুলাই আন্দোলনের গ্রাফিতির ওপর।
আগ্রাবাদ আখতারুজ্জান সেন্টারের সামনের এক্সপ্রেসওয়ের পিলারে জুলাই গ্রাফিতির ওপর ঈদ শুভেচ্ছার পোস্টার লাগিয়েছেন একেএম আবু তাহের বিএসসি নামে এক বিএনপি নেতা। চট্টগ্রাম-৪ আসন থেকে তিনি বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী। তার পোস্টারে চাপা পড়েছে গ্রাফিতিতে আঁকা লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা।
কথা হলে একেএম আবু তাহের বিএসসি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি আগামীতে চট্টগ্রাম-৪ সংসদীয় আসন থেকে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী। ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে আমার পোস্টারিং হয়েছে। এসব পোস্টার তো আমি নিজে লাগাইনি। যারা লাগিয়েছেন তারা হয়তো ভুলে কোথাও জুলাই গ্রাফিতিতে লাগিয়েছেন। আমরা তো জুলাই আন্দোলনে একাত্ম ছিলাম। জুলাই আন্দোলনে আমাদের সম্মান রয়েছে।’
চট্টগ্রাম মহানগরীতে দর্শনীয় অনেক স্থানে গ্রাফিতি রয়েছে। এসব গ্রাফিতি ঢেকে দেওয়া দুঃখজনক। এখন এসব গ্রাফিতি মুছতে বা ঢাকতে যেসব রাজনৈতিক দল কিংবা সামাজিক সংগঠনের ভূমিকা রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনের প্রতি দাবি জানাই।- এনসিপি চট্টগ্রাম মহানগরের যুগ্ম মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) ইমন সৈয়দ
আগ্রাবাদ মোড়ে মহানগর যুবদলের সাবেক সভাপতি মোশাররফ হোসেন দীপ্তির ব্যানার দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে জুলাই আন্দোলনের গ্রাফিতি। আবার সামাজিক সংগঠনের পোস্টারও লেগেছে এসব গ্রাফিতির ওপর। এ বিষয়ে জানতে ফোন করা হলে মায়ের অসুস্থতাজনিত কারণে হাসপাতালে রয়েছেন বলে জানান মোশাররফ হোসেন দীপ্তি।
আগ্রাবাদ এলাকায় ‘প্রচারে আমরা সিঅ্যান্ডএফ পরিবার’ লিখে জুলাই গ্রাফিতির ওপর ঈদ শুভেচ্ছার পোস্টার সাঁটিয়েছেন মো. মাহবুবুর রহমান সাগর নামে এক ব্যক্তি। তিনি নিজেকে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ক্রীড়া সংগঠক বলে ওই পোস্টারে উল্লেখ করেছেন।
গ্রাফিতির ওপর ঈদ শুভেচ্ছার পোস্টার লেগেছে ডবলমুরিং থানা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মো. নুর উদ্দিন সোহেলেরও। তার পোস্টারে জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া, তারেক রহমানের পাশাপাশি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও খসরুপুত্র ইসরাফিল খসরুর ছবিও রয়েছে।
আগ্রাবাদ চৌমুহনী মোড়ের সম্মুখভাগের পিলারটিতে বড় পোস্টার লাগিয়েছেন মো. আবদুল আজিজ। পোস্টারটিতে লেখা রয়েছে ‘চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জনাব এস এম সাইফুল আলম ভাইয়ের পক্ষ থেকে পবিত্র ঈদ-উল ফিতরের শুভেচ্ছ ও ঈদ মোবারক।’ পোস্টারটিতে সাইফুল আলমের ছবিও রয়েছে বড় করে। আবদুল জলিল নিজেকে ডবলমুরিং থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী বলে পোস্টারে উল্লেখ করেন। ওই এলাকায় বেশ কয়েকটি পিলারে ঈদ শুভেচ্ছার পোস্টার লাগিয়েছেন মীর পারভেজ আহম্মেদ নামে আরেক যুবদল নেতা। তিনিও ডবলমুরিং থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী বলে পোস্টারে উল্লেখ করেছেন।
লালখান বাজার এলাকার জুলাই গ্রাফিতির ওপর ঈদ শুভেচ্ছার পোস্টার লাগিয়েছেন মোস্তাফিজুর রহমান সুমন নামে এক নেতা। পোস্টারে তিনি ‘শুভেচ্ছান্তে- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, ১৪নং লালখান বাজার ওয়ার্ডের সর্বস্তরের জনগণ’ উল্লেখ করেছেন।
টাইগারপাস মোড় এলাকার একটি পিলারে আঁকা গ্রাফিতির ওপর ঈদ শুভেচ্ছার পোস্টার সাঁটিয়েছেন মো. নবী হোসেন নামে এক ব্যক্তি। ওই পোস্টারে তিনি নিজেকে চট্টগ্রাম মহানগর জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) সাংগঠনিক সম্পাদক দাবি করেছেন।
আগ্রাবাদ থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পিলারে গ্রাফিতির ওপর ‘ওমর ফিটনেস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনী পোস্টার সাঁটানো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জুলাই আন্দোলনের গ্রাফিতি পুরোপুরি ঢেকে দেওয়া হয়েছে। লালখান বাজার অংশে প্রতিষ্ঠানটির কয়েকটি পোস্টারে ঢেকেছে গ্রাফিতিতে আঁকা শহীদ আবু সাঈদের মুখ ও বাংলাদেশের মানচিত্রও।
জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির মালিক ওমর ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা রিসেন্টলি পোলাপাইন দিয়ে পোস্টারগুলোর লাগিয়েছি। তারা জুলাই গ্রাফিতিতে লাগিয়েছে কি না জানি না। যতদূর জানি পুরোনো পোস্টারের ওপর আমাদের পোস্টার লাগিয়েছে। ইচ্ছা করে কোনো গ্রাফিতিতে পোস্টার লাগায়নি। তারপরেও এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত।’
অন্যদিকে কাজীর দেউড়ি এলাকার দেওয়ালে আঁকা গ্রাফিতি ‘পানি লাগবে পানি’ ‘মুগ্ধ পানি’র ওপরে ভাষা দিবসের শহীদদের শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো পোস্টার দেখা গেছে। ওই পোস্টারে বড় করে রয়েছে মো. আবুল হোসেন এবং মো. ইদ্রিস নামে দুই যুবদল নেতার ছবি। পোস্টারটিতে ইদ্রিস নিজেকে চট্টগ্রাম মহানগর যুবদলের সাবেক সমবায় বিষয়ক সম্পাদক উল্লেখ করেছেন।
আগামী ১১ এপ্রিল চট্টগ্রাম এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে স্বাধীনতা কনসার্ট। এ কনসার্টের স্লোগান দেওয়া হয়েছে ‘সবার আগে বাংলাদেশ’। দেশের শীর্ষ তারকা গায়কেরা এ কনসার্টে গাইবেন। পারফর্ম করবে দেশের জনপ্রিয় ব্যান্ডদলগুলো। এই স্বাধীনতা কনসার্টের পোস্টারেও অনেক স্থানে জুলাই গ্রাফিতি ঢাকা পড়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘১১ এপ্রিল এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে স্বাধীনতা কনসার্ট অনুষ্ঠিত হবে। তারা প্রচার ব্যানার লাগানোর জন্য অনুমোদন চেয়ে সিটি করপোরেশনে আবেদন করেছে। ১১ এপ্রিল এ কনসার্ট শেষ হলে আমরা ম্যাসিভ আকারে নগরীতে যত্রতত্র সাঁটানো ব্যানার-পোস্টার অপসারণ করবো। জুলাই আন্দোলনের গ্রাফিতির ওপর পোস্টার লাগানো হলে তাও অপসারণ করা হবে।’
জাতীয় নাগরিক কমিটি (এনসিপি) চট্টগ্রাম মহানগরের যুগ্ম মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) ইমন সৈয়দ জাগো নিউজকে বলেন, ‘চব্বিশের জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতন ঘটানো হয়েছে। দেশের মানুষ বিগত ১৭ বছরের ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের নির্যাতনের হাত থেকে মুক্ত হয়েছে। এই আন্দোলন ও আগামীর বাংলাদেশের যে আকাঙ্ক্ষা ৫ আগস্টের পরে শিক্ষার্থীরা তা গ্রাফিতির মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। আমরা এখন যে নতুন সংবিধানের কথা বলছি, তাও শিক্ষার্থীদের আঁকা গ্রাফিতিতে প্রকাশ পেয়েছে। এসব গ্রাফিতি আমাদের ইতিহাসের অংশ।’
তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগরীতে দর্শনীয় অনেক স্থানে গ্রাফিতি রয়েছে। এসব গ্রাফিতি ঢেকে দেওয়া দুঃখজনক। এখন এসব গ্রাফিতি মুছতে বা ঢাকতে যেসব রাজনৈতিক দল কিংবা সামাজিক সংগঠনের ভূমিকা রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনের প্রতি দাবি জানাই।’