Image description

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানকালে পুলিশের থানা ও ফাঁড়ি থেকে বিপুল অস্ত্র ও গুলি লুট হয়। বেহাত হওয়া এসব অস্ত্র ও গুলি ব্যবহার করা হচ্ছে খুনখারাবি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, মাদক কারবার, ডাকাতি, ছিনতাই, আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব থেকে শুরু করে অন্যান্য অপরাধে। অপরাধীচক্র লুণ্ঠিত অস্ত্র দিয়ে হাত পাকাচ্ছে; বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও নিজেদের পেশী শক্তির জানান দিচ্ছেন।

 

এসব অস্ত্র দিয়েই ‘কথায়-কথায়’ একে অপরের দিকে গুলি ছুড়ছে। ঘটছে হতাহতের ঘটনা। আইনশৃঙ্খলার জন্য এখন বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে লুণ্ঠিত অস্ত্র।

এদিকে বেহাত অস্ত্র উদ্ধার এখন র‌্যাব, পুলিশসহ যৌথ বাহিনীর মাথাব্যথার বড় কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে এসব অস্ত্র উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চলমান অভিযান আরও জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির এক সভায় এ ব্যাপারে দেওয়া হয়েছে বিশেষ নির্দেশনা।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) জানিয়েছেন, বিভিন্ন থানা থেকে গত ৫ আগস্টের পর লুট হওয়া সব অস্ত্র উদ্ধার হলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে।

পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্থাপনা থেকেই নয়, গত বছর ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালী নেতাদের বাসা থেকেও লাইসেন্স করা অস্ত্র-গুলি লুট হয়। এসব লুটের অস্ত্র হাতবদল হয়ে পেশাদার অপরাধীদের পাশাপাশি আন্ডারওয়ার্ল্ডের বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের হাতে চলে গেছে। এ ছাড়া লুণ্ঠিত অস্ত্র ডাকাত, ছিনতাইকারী, অপহরণকারীচক্র, কিশোর গ্যাং, জলদস্যু, বনদস্যু এমনকী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের কাছেও হাতবদল হয়ে পৌঁছে গেছে। বেহাত অস্ত্র দিয়েই তারা নানা অপরাধে নিজেদের হাত পাকাচ্ছে। এ কারণে লুটের অস্ত্র এখন দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বড় ধরনের হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। এখনো লুুণ্ঠিত অস্ত্র অপরাধজগতে বেচাকেনা হচ্ছে বলে গোয়েন্দা তথ্য পাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকালে বিভিন্ন থানা-ফাঁড়ি, পুলিশ বক্সসহ ইউনিট-স্থাপনা থেকে ৫ হাজার ৭৫০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৬ লাখ ১২ হাজার ৯৮৮টি গোলাবারুদ

লুট হয়। লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদের মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের রাইফেল, এসএমজি, এলএমজি, পিস্তল, শটগান, গ্যাসগান, টিয়ার গ্যাস লঞ্চার, টিয়ার গ্যাস শেল, টিয়ার গ্যাস স্প্রে, সাউন্ড গ্রেনেড ও বিভিন্ন বোরের গুলি। গত ৬ এপ্রিল পর্যন্ত ৪ হাজার ৩৭২টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এখনও ১ হাজার ৩৭৮টি অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। অন্যদিকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত ৩ লাখ ৬৭ হাজার ৭৩২টি গোলাবারুদ উদ্ধার হয়। এখনও ২ লাখ ৪৫ হাজার ২৫৬টি গোলাবারুদ উদ্ধার হয়নি। লুুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারে গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর আমাদের সময়কে বলেন, এরই মধ্যে ৭৬ থেকে ৭৭ শতাংশ অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার হয়েছে। এখনও বেহাত থাকা অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারে পুলিশের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা রয়েছে। এ কাজে আমরা জনগণেরও সহায়তা চাচ্ছি। কারও কাছে এ ব্যাপারে তথ্য থাকলে পুলিশকে জানানোর অনুরোধ জানাচ্ছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, লুট হওয়া অস্ত্র যত বেশি সময় উদ্ধারের বাইরে থাকবে, আইনশৃঙ্খলার জন্য চ্যালেঞ্জও তত বাড়বে। অপরাধী গ্রুপগুলোর মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষের ঝুঁঁকি বাড়বে। মানুষের বিরুদ্ধেও এসব অস্ত্র ব্যবহার হবে। একজন অপরাধীর কাছে অস্ত্র থাকার মানে হচ্ছে, তার অপরাধ করার ক্ষমতা কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়া। এখন জোরালো অভিযান চালিয়ে অস্ত্রগুলো উদ্ধারই একমাত্র সমাধান।

১ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরে স্থানীয় দুটি সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে চলা গোলাগুলির সময় আবিদা সুলতানা নামে ৬ বছরের এক শিশু গুলিবিদ্ধ হয়। শিশুটির চিকিৎসা চলছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তার অবস্থা এখনও শঙ্কামুক্ত নয় বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

গত ২ এপ্রিল দিবাগত রাতে খুলনা মহানগরীর হরিণটানা থানার বাঙ্গালবাড়ী রোডে সন্ত্রাসী দুই গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি হয়। এতে খাইরুল সরদার নামে গুলিবিদ্ধ একজনকে ভর্তি করা হয় খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তার দেওয়া তথ্যেই পুলিশ অস্ত্র বিক্রেতা হরিণটানা এলাকার ফারুক হোসেনকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় ফারুকের বাড়ি থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল, একটি শটগান এবং শটগানের সাত রাউন্ড কার্তুজ, পিস্তলের আট রাউন্ড গুলি এবং এক রাউন্ড এমটি কার্তুজ উদ্ধার করে।

গত ৩ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টার দিকে পল্লবীর বাউনিয়াবাদ ই ব্লক এলাকায় মাদক ব্যবসা কেন্দ্র করে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় একজন গুরুতর আহত হন। স্থানীয়রা জানান, ভাষানটেকের ইব্রাহিম ও মামুন বাহিনীর সদস্য বুক পোড়া সুজন, মাদক ব্যবসায়ী পাতা সোহেল, হোসেন, বাবলু ও তার ভাগিনাসহ অজ্ঞাত আরও আটজন এই হামলার সঙ্গে যুক্ত। এদের হাতে পুলিশের লুণ্ঠিত অস্ত্র রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান।

৩ মার্চ রাতে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় গণপিটুনিতে দুজন নিহত হন। দুজনের একজন কোতোয়ালি থানা থেকে লুট হওয়া একটি পিস্তল থেকে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে স্থানীয় লোকজনকে লক্ষ্য করে। পুলিশ রাতেই ঘটনাস্থল থেকে পিস্তলটি উদ্ধার করে এবং এ ঘটনায় একটি মামলা করে। নিহত নেজাম স্থানীয় জামায়াতের সক্রিয় কর্মী ছিলেন।

১১ মার্চ রাতে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর কালুরঘাট এলাকায় মেলার টেন্ডারবাজিতে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলি ঘটে। এতে অন্তত পাঁচজন আহত হন। সংঘর্ষের পর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছালে হামলাকারীরা সরে যায়। এ ঘটনায় দুই পক্ষই বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে গোলাগুলিতে লিপ্ত হয় বলে পুলিশ জানিয়েছে।

১৭ মার্চ রাত ১০টার দিকে ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার পাগলা খানা এলাকায় নদী থেকে বালু উত্তোলন নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় মেহেদি হাসান রাকিব নামে এক যুবক নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হন আরও একজন।

২১ মার্চ রাতে চট্টগ্রামে ঈদের শুভেচ্ছা ব্যানার টানানো নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে দুজন গুলিবিদ্ধ ও একজন ছুরিকাহত হন। নগরের খুলশী থানার কুসুমবাগ আবাসিক এলাকায় এ ঘটনার জেরে খুলশী থানার ওসি মুজিবুর রহমানকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়।

৩১ মার্চ সন্ধ্যায় কক্সবাজারের রামু উপজেলার কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের চৌধুরী খামার পাড়ায় মিয়ানমার থেকে অবৈধ পথে আনা গরু পাচারকে কেন্দ্র করে দুই সন্ত্রাসী বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলির ঘটনায় মোহাম্মদ নবী নামে একজন নিহত হন। মোহাম্মদ নবী ও আজিজুল হক বাহিনীর মধ্যে এই সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষকালে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলি চালায়। এতে মোহাম্মদ নবীসহ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন। গুলিবিদ্ধ মোহাম্মদ নবীকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান। রাতে সন্ত্রাসীদের আস্তানা থেকে দুটি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ।