Image description
বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ড

রাজধানীর বঙ্গবাজারে দুই বছর আগে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও দোকান কর্মচারীদের সহায়তায় একটি উন্মুক্ত তহবিল গঠন করা হলে তাতে জমা পড়ে সাড়ে ৬ কোটি টাকা। তবে গত দুই বছরে সেই তহবিলের কানাকড়িও বণ্টন করা হয়নি। এর বাইরে ঢাকা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে দান হিসেবে সংগ্রহ করা সাড়ে তিন কোটি টাকা বণ্টনেও নয়ছয়ের অভিযোগ রয়েছে। কাদের মধ্যে ওই টাকা বিতরণ করা হয়েছে, তা ব্যবসায়ী নেতারা জানেন না বলে দাবি করেছেন। এ ছাড়া অগ্নিকাণ্ডের পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত ঈদ উপহারের ৯ কোটি টাকার মধ্যে ৬ কোটি টাকাই বণ্টনের নামে লুটপাট হয়েছে বলেও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ রয়েছে। তাদের স্থায়ী পুনর্বাসনে জন্য ভবন নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ধীরগতিতে নির্মাণকাজ করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল ভোরে আগুন লাগে বঙ্গবাজারে। ঈদুল ফিতরের আগে ১২তম রোজার দিনে লাগা সেই অগ্নিকাণ্ডে মালামালসহ দোকান পুড়ে যাওয়ায় নিঃস্ব হয়ে যান হাজারো ব্যবসায়ী।

সংশ্লিষ্টরা জানান, অগ্নিকাণ্ডের পর ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনসহ অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তায় অনুদান দিয়েছিলেন। তখন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন, বঙ্গবাজার দোকান মালিক সমিতির কার্যকরী সভাপতি নাজমুল হুদা ও যুগ্ম সম্পাদক

 

মো. জহিরুল হকের নামে আইএফআইসি ব্যাংকে যৌথ হিসাব খুলে সেখানে অনুদানের অর্থ রাখা হয়। সব মিলিয়ে আইএফআইসি ব্যাংকের ওই সঞ্চয়ী হিসাবে জমা পড়ে ৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। কিন্তু দুই বছর অতিবাহিত হলেও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা সেই তহবিল থেকে এখনো কোনো অর্থ পাননি।

 
 

এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় সাড়ে তিন কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহ করে ঢাকা জেলা প্রশাসন। সে সময় আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ১ হাজার ২০০ দোকানকর্মী ও ৬০০ ব্যবসায়ীর তালিকা করার কথা জানিয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়, ক্ষতিগ্রস্তদের শিল্পকলা একাডেমি ও শিশু একাডেমিতে ডেকে জনপ্রতি ১০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। তবে সে সময় জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে সহায়তা পেয়েছেন—এমন কোনো ব্যবসায়ী, ভাড়াটিয়া বা কর্মচারীর খোঁজ পাওয়া যায়নি। একাধিক ব্যবসায়ী নেতা জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসন কাদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করেছে, কাদের দিয়েছে—এ বিষয়ে মার্কেট সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ বা সমন্বয় করেনি। তারা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা কোথায় পেয়েছে, তাও তারা জানেন না।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগই বিভিন্ন ব্যাংক বা আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করছিলেন। আগুনে সব হারিয়ে এখন তারা ঋণে জর্জরিত। কেউই এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। ঋণের বোঝা থেকে কীভাবে মুক্তি পাবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তারা।

শাহ আলম নামে ক্ষতিগ্রস্ত এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘দোকান পুড়ে ৮ লাখ টাকার ক্ষতি হলেও কোনো সহযোগিতা পাইনি। আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে কোনোরকম ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছি। নির্মাণাধীন নতুন মার্কেটে দোকানের জন্য তিন লাখ টাকা সালামি ব্যাংকে জমা দিয়েছি।’

মায়মুনা গার্মেন্টসের মালিক জালাল উদ্দিন বলেন, ‘আমার ও আত্মীয়স্বজনের মিলে ৩০টির মতো দোকান ছিল। কেউই কোনো সহযোগিতা পাইনি। ৯ কোটি টাকা কর্মচারীদের ঈদ বোনাস বিতরণের গল্প শোনানো হলেও পাঁচ হাজার জনের মধ্যে তিন ভাগের এক ভাগ কর্মচারী ২৫ হাজার টাকা করে পেয়েছেন। বাকি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।’

ভাই ভাই গার্মেন্টসের মালিক মাসুদ শিকদার বলেন, ‘আমার দোকানে ৭০ লাখ ও আমার ভাই হারুন শিকদারের শাড়ির দোকানে ৪৭ লাখ টাকার মালপত্র পুড়ে গেছে। আমি বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন থেকে ১ লাখ টাকা পেয়েছি।’

দোলন গার্মেন্টসের মালিক মো. মুহিন বলেন, ‘তিনটি দোকান পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরিবার চালাতে আমরা এখন হিমশিম খাচ্ছি। একেকজনের কাঁধে লাখ লাখ টাকার ওপরে ঋণ। কারও ঋণের পরিমাণ আরও বেশি। বঙ্গবাজারে আমরা যারা ব্যবসা করতাম, তাদের সবার কাঁধেই ঋণের বোঝা। সে সময় পত্রিকা-টিভিতেও দেখেছি প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে আমাদের সহযোগিতা করার জন্য টাকা দেওয়া হয়েছে। তখন মালিক সমিতির নেতারা বলেছেন, তোমাদের সবার জন্য অনুদান এসেছে। যার যত ক্ষতি হয়েছে বা যতটা দোকান ছিল, সেই হিসাব করে অনুদানের টাকা দেওয়া হবে। কিন্তু পরে এর কানাকড়িও পাইনি।’

এ ছাড়া আরও ১০ জন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয়েছে কালবেলার, যাদের কেউই আর্থিক সহযোগিতা বা অনুদান পাননি বলে জানিয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, তারা সবাই এখন ঋণে জর্জরিত; ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কিত তারা।

তিশা গার্মেন্টসের মালিক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এখনো প্রায় ৩৫ লাখ টাকার ওপরে ঋণ আছে। রাতে ঋণের চিন্তায় ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না, কী করে এই ঋণ পরিশোধ করব! শুধু আমি নয়, আমার মতো যারা বঙ্গবাজারে ব্যবসা করেছি, এক আগুনে পথের ফকির হয়ে গেছি। আমাদের সর্বনাশ দেখে অনেকে মালিক সমিতির ফান্ডে টাকা দিয়েছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা সেখান থেকে এক পয়সাও পাইনি। আমার কথা হলো, সেই টাকা গেল কোথায়? কেন আমাদের দেওয়া হয়নি? এই জবাব আমরা কার কাছে চাইব।’

ক্ষতিগ্রস্ত আরেক ব্যবসায়ী এনএম সিল্ক হাউসের মালিক মো. নুরুন্নবী বলেন, ‘আমার তিন দোকানে চার কোটি টাকার বেশি মালামাল ছিল। এর মধ্যে ৯০ লাখ টাকা ব্যাংকের ঋণ এবং আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার নেওয়া। আমি এখন ঋণে জর্জরিত। ঋণের বোঝায় জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।’ আর্থিক কোনো সহযোগিতা পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘দোকান মালিক সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা সান্ত্বনা দিয়েছিলেন– আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ নিয়ে দেওয়া হবে। শুনেছি সে সময় টাকাও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারের পরিবর্তনের পর তারা সবাই টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে। আমাদের একবার কপাল পুড়েছে আগুনে, তার ওপর যে অনুদান পাওয়ার কথা ছিল সেটাও কপালে জুটল না।’

সালাউদ্দিন নামে এক ব্যবসায়ী জানান, তাদের পারিবারিক দুটি দোকান পুড়লেও তারা কোনো অনুদান পাননি। ছয় কর্মচারীর একজন প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহারের ২৫ হাজার টাকা পেয়েছেন।

ডিএসসিসি গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের ৪টি ইউনিটে (বঙ্গবাজার, গুলিস্তান, মহানগর ও আদর্শ) সব মিলিয়ে দোকান ছিল ২ হাজার ৯৬১টি। এ ছাড়া মহানগর শপিং কমপ্লেক্সে ৭৯১টি, বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেটে ৫৯টি ও বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্সে ৩৪টি দোকান আগুনে পুড়েছে। সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৮৪৫টি দোকান সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিস গঠিত আলাদা তদন্ত কমিটি তখন বলেছিল, মার্কেটের তৃতীয় তলায় একটি টেইলার্সে মশার কয়েলের আগুন বা শর্টসার্কিট থেকে বঙ্গবাজারে আগুনের সূত্রপাত হয়। তবে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন, তাদের সরাতে না পেরে সিটি করপোরেশনসহ স্বার্থান্বেষী মহল পরিকল্পিতভাবে মার্কেট পুড়িয়ে দিয়েছে। বহুতল মার্কেট করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে তারা ব্যবসায়ীদের নিঃস্ব করে দিয়েছে।

গত বছরের ২২ অক্টোবর বঙ্গবাজারে পরিকল্পিতভাবে আগুন দেওয়ার অভিযোগ এনে ৩০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী মিরপুর এলাকার বাসিন্দা কামাল হোসেন রিপন বাদী হয়ে ৫০০ কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতির অভিযোগ এনে শাহবাগ থানায় মামলাটি করেন। ওই মামলার আসামিদের মধ্যে রয়েছেন ডিএসসিসির সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান, কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য আফজাল হোসেন, ২০ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন রতন, শাহবাগ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আতিকুর রহমান, বঙ্গবাজার মার্কেট সমিতির সহসভাপতি নাজমুল হাসান ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম।

মামলাটির তদন্ত করছেন শাহবাগ থানার এসআই মাইনুল ইসলাম খান পুলক। তিনি বলেন, ‘আলামত বিবেচনায় নিয়ে মামলাটির তদন্ত করছি। প্রথমেই আসামিদের ধরার চেষ্টা করছি। এ পর্যন্ত দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আশা করছি অন্যদের ধরতে পারলে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে।’

অনুদানের টাকা কেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের দেওয়া হয়নি জানতে বঙ্গবাজার দোকান মালিক সমিতির কার্যালয়ে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগের অনুসারী সংগঠনের নেতারা সরকার পতনের পর থেকে পলাতক।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের সহযোগিতার জন্য ৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছিল। টাকাগুলো এখনো ব্যাংকে রয়েছে। এখানে ক্ষতিগ্রস্ত দোকান মালিকদের তালিকা নিয়ে ঝামেলা থাকায় তা বণ্টন করা যায়নি। সাবেক মেয়র শেখ তাপস বলেছিলেন, চার হাজার দোকান মালিককে ৬ কোটি দিলে একেকজন পাবেন মাত্র ৭-৮ হাজার টাকা, এটা তাদের তেমন কাজে লাগবে না। সে সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন আরও ১৫ কোটি টাকা দেবেন। ওই টাকা পেলে বিতরণের কথা ছিল। তবে সরকার পরিবর্তনের কারণে ওই ১৫ কোটি টাকা আর পাওয়া যায়নি।’

তিনি বলেন, ‘মার্কেটটি সিটি করপোরেশনের। টাকাটি সচিবের মাধ্যমে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হবে। আমরা অনুরোধ করব, টাকা বিতরণের দায়িত্ব যেন সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ নেয়।’

কর্মচারীদের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহারের ৯ কোটি টাকা বিতরণের বিয়য়ে জানতে চাইলে হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে বলে শুনেছি। তবে আমাদের কাছে কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই। আমাদের মাধ্যমে তা দেওয়া হয়নি।’

জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সচিব মোহাম্মদ বশিরুল হক ভূঁঞা কালবেলাকে বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তা হিসেবে দুই কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে সিটি করপোরেশন। শিগগির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা থাকা সহায়তার টাকা ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। মূলত ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা নিয়ে আপত্তি থাকায় টাকা বণ্টন হয়নি।’