
প্রায় ১০ বছর আগে মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে তৎকালীন সরকার। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ৪ মে ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ প্রতিপাদ্যে কঠোর অভিযান শুরু করে র্যাব। এরপর পুলিশসহ অন্য বাহিনীর সদস্যরাও দেশজুড়ে অভিযান শুরু করেন। অভিযানের প্রথম তিন সপ্তাহে কথিত ক্রসফায়ারে নিহত হন অন্তত ৪০ জন।
বছরজুড়ে নিহত হন চার শতাধিক। নিহতদের এই তালিকায় ব্যাপক আলোচিত টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হককে হত্যার ঘটনাটিও ছিল। মাদকের গডফাদার ও মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকাও তৈরি হয়। কিন্তু যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয় বা যাঁরা ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হন তাঁদের তালিকায় মাদকের গডফাদাররা যুক্ত হননি।
মাদকের মূল হোতারা আড়ালেই থেকে যান। উপরন্তু মাদকবিরোধী অভিযানে নিহতের সংখ্যা বৃদ্ধিতে ওই প্রক্রিয়ার বৈধতা, উদ্দেশ্য এবং কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ‘ক্রসফায়ারেও থামেনি মাদকের কারবার’, ‘মাদক ব্যবসার চেয়ে বড় অপরাধ ক্রসফায়ার’— এ ধরনের শিরোনামে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। তার পরও সাত বছর আগের সেই অভিযান শুরুতে কিছুটা কার্যকর ছিল বলেই কারো কারো দাবি। কিন্তু বর্তমানে মাদকবিরোধী অভিযান তেমন দৃশ্যমান নয় বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে সুযোগ নিচ্ছে মাদকসেবী ও কারবারিরা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি), পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও কোস্ট গার্ড—এই পাঁচ সংস্থার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ১৬ বছরে (২০০৯-২০২৪) ১১ লাখ ৫২ হাজার ৫৯৫টি মাদক মামলা হয় এবং গ্রেপ্তার করা হয় ১৪ লাখ ৬২ হাজার ৭৭৯ জনকে। এ সময় উল্লেখযোগ্য জব্দের মধ্যে ছিল ৩৮ কোটি ৭৮ লাখ ৫১ হাজার ৩৯৫ পিস ইয়াবা, হেরোইন চার হাজার ৫২৮ কেজি, কোকেন ১৯৫ কেজি, আফিম ৩৬৯ কেজি, গাঁজা ৯ লাখ ৮৫ হাজার ৪৫৯ কেজি, এক কোটি ৩২ লাখ ৮১ হাজার ৫৪৮ বোতল ও ২২ হাজার ৯৪৬ লিটার ফেনসিডিল), ৩২ লাখ আট হাজার ৪২৭ বোতল বিদেশি মদ, ৪৮ হাজার ৭৬৮ লিটার বিদেশি মদ ও ১৩ লাখ ৯৬ হাজার ৬২৩ ক্যান বিয়ার। আর ওই ১৬ বছরের ব্যবধানে ইয়াবা জব্দ বেড়েছে ১৭৩ গুণ, হেরোইনে বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি, গাঁজা চার গুণ ও বিদেশি মদ আট গুণের বেশি।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য বলছে, প্রতিদিনই বাস, প্রাইভেট কার, ট্রেন কিংবা জরুরি পণ্যের ট্রাক, জ্বালানি তেলের লরি, অ্যাম্বুল্যান্স ও পিকআপসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অভিনব কায়দায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে মাদক সরবরাহ করছে কারবারিরা। এসবের মধ্যে রয়েছে ইয়াবা, হেরোইন, মদ, বিয়ার, গাঁজা, ফেনসিডিল ও আইসসহ অনন্ত ২৫ ধরনের মাদকদ্রব্য। সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিদিন জব্দ করছে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য। এসব ঘটনায় জড়িদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। মামলাও হচ্ছে ।
পাঁচটি সংস্থার তথ্য বলছে—চলতি বছরে ইয়াবা, ফেনসিডিল, বিদেশি মদ ও ইনজেকটিং ড্রাগ জব্দের পরিমাণ গত বছরের তুলনায় ব্যাপক বেড়েছে। যেখানে গত বছর প্রতি মাসে গড়ে ১৯ লাখ চার হাজার ৮১৩ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়, সেখানে চলতি বছরে প্রথম জানুয়ারি মাসেই দ্গুিণের বেশি (৩৯ লাখ ৮৫ হাজার ২০৫ পিস) ইয়াবা জব্দ করা হয়। গত বছর প্রতি মাসে গড়ে ৪৭ হাজার ৭৩৯ বোতল ফেনসিডিল জব্দ করা হলেও এ বছরের জানুয়ারিতে ৫৮ হাজার ৯৮৫ বোতল জব্দ করা হয়। এ ছাড়া গত বছর যেখানে প্রতি মাসে গড়ে তিন লিটার নেসিডিল জব্দ হয়, সেখানে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৬৮ লিটার ফেনসিডিল জব্দ করা হয়। গত বছরে প্রতি মাসে গড়ে মাদকের মামলা হয়েছে পাঁচ হাজার ৭০৫টি, এ বছরের জানুয়ারিতে হয়েছে ছয় হাজার ১৬৬টি। গত বছর গ্রেপ্তার হয়েছে সাত হাজার ৭১ জন। সে তুলনায় গত জানুয়ারিতে এক মাসেই গ্রেপ্তার হয় সাত হাজার ৫০৫ জন।
ডিএনসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে মাদকপাচারের বিষয়টি বেলুনের মতো। এক দিক দিয়ে কমলে অন্যদিক দিয়ে বাড়ে। হেরোইনের চালান বেড়েছে। গত বছর এই মাদকদ্রব্য যে পরিমাণ জব্দ হয়েছে, চলতি বছরেও যে পরিমাণ জব্দ করা হচ্ছে। এতে বলা যায় পরিস্থিতি ভয়াবহ। ডিএনসির পরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড গোয়েন্দা) তানভীর মমতাজ কালের কণ্ঠকে বলেন, গত দেড়-দুই বছরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বেশি দৃষ্টি ছিল ইয়াবা ও আইসে। এর মধ্যে হঠাৎ হেরোইন-কোকেন আসা বেড়েছে। অন্যান্য মাদকদ্রব্যের সঙ্গে এসব মাদকদ্রব্যও জব্দ করতে অভিযান জোরদার করা হচ্ছে। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিকুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মাদক কারবারিদের সম্ভাব্য গতিবিধির ওপর সব সময় র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে। কারবারিরা যেমন নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করছে. আমরাও সেভাবে অভিযান পরিচালনা করছি। এতে বিভিন্ন অপকৌশল করেও মাদক কারবারিরা রেহাই পাচ্ছে না। প্রতিদিনই মাদক কারবারি ও সরবরাহকারীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিবছরের মাদক উদ্ধারের পরিসংখ্যানের চিত্রই বলে দিচ্ছে সার্বিকভাবে মাদকের বিস্তার দিন দিন বাড়ছে। কারণ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যে পরিমাণ মাদক জব্দ করে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সেবীদের কাছে চলে যায়। মাদক নির্মূল করে দেশের তরুণদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে মাদক কারবারের মূল হোতাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে গড়ে তুলতে হবে সচেতনতা।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র বলছে, বেশির ভাগ অপরাধের পেছনে কোনো না কোনোভাবে রয়েছে মাদক। পারিবারিক নৃশংসতা, চুরি-ছিনতাইসহ ধর্ষণের মতো ঘটনার পেছনেও রয়েছে মাদক। আর মাদকসেবীদের বেশির ভাগই তরুণ। মাদকের বিরুদ্ধে যেভাবে গণসচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলন দরকার তা হচ্ছে না।
টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মাদকের চাহিদা থাকার কারণে বাড়ছে জোগান। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বে যাঁরা আছেন তাঁরা নিজেরাই যদি এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, তাহলে মাদকের জোগান বন্ধ করা কঠিন। তাই জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নে অর্থনৈতিক প্রলোভন, রাজনৈতিক চাপ এড়িয়ে দায়িত্ব পালনে আরো কঠোর হতে হবে। একই সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার উদ্যোগে মাদক উৎপাদন, বিক্রয় ও সরবরাহকারী— এই জায়গাগুলো বন্ধ না করা না গেলে মাদকের বিস্তার কমানো যাবে না।’