
সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের শাহপরীর দ্বীপের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আবদুস সালাম আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্য দখল করার পর জেলে অপহরণ ও আটক বেড়েছে । জেলেরা মাছ ধরে ফেরার পথে আরাকান আর্মিরা তাঁদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে । ফলে জেলেরা আতঙ্ক নিয়ে সাগরে যাচ্ছেন ।
আবদুস সালাম আরও বলেন , জেলেরা চর এড়িয়ে গভীর জল দিয়ে উপকূলে আসে । এই রুটটা মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি । এই সুযোগটাই নিচ্ছে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের নৌবাহিনী । এ পথ থেকে তাঁদের অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় । গত ফেব্রুয়ারিতে অপহরণের শিকার হন শাহপরীর দ্বীপের দক্ষিণ পাড়ার হাবীব নামের এক জেলে । ওই ঘটনার পর তিনি আর সাগরে মাছ শিকারে যাননি । তিনি বলেন , “মাছ শিকার করে আসার বোটগুলো আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার নৌবাহিনী টার্গেট ( নিশানা ) করে । তারা ট্রলারসহ জেলেদের নিয়ে যায় । মাছ নিয়ে যায় । ’
ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তে হত্যা - অপহরণ আতঙ্ক
এলাকার একটি সূত্র জানিয়েছে , কোনো কোনো নৌযানের মালিক আরাকান আর্মিকে টাকা দিয়ে জেলে ও নৌযান ছাড়িয়ে আনেন । টাকা না দিলে কয়েক দিন জেলেদের আটকে রাখে আরাকান আর্মি । বিজিবির একটি সূত্র জানিয়েছে , গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ৬ মার্চ পর্যন্ত নাফ নদী ও সাগরে ১৩ টি অপহরণে জড়িত আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার নৌবাহিনী । এর মধ্যে ১২ টিই করেছে আরাকান আর্মি । এসব ঘটনায় জেলেসহ ৪৪ বাংলাদেশি ও ১৪ জন রোহিঙ্গাকে অপহরণ করে তারা । পরে আলোচনার মাধ্যমে তাঁদের ফিরিয়ে আনে বিজিবি । গত পাঁচ মাসে তারা ইঞ্জিনচালিত ৭ টি মাছধরার ট্রলার নিয়ে যায় । সেগুলোও ফেরত এনেছে বিজিবি । আর মিয়ানমারের নৌবাহিনী গত ৫ মার্চ মাছ ধরার ছয়টি ট্রলার অপহরণ করে । এসব নৌযানে ৫৬ জল জেলে ছিলেন । ওই দিন রাতেই তাঁদের ফেরত আনে বিজিবি । গতকাল সকালে কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিনের অদূরে সাগরে মাছ ধরার সময় দুটি ট্রলারসহ ১১ জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মির সদস্যরা । শাহপরীর দ্বীপ দক্ষিণ পাড়া ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি বশির আহমেদ বলেছেন , ট্রলার নিয়ে মাছ শিকারে এখন জেলেদের আতঙ্ক রয়েছে । তবু পেটের দায়ে সাগরে ছুটতে হয় তাঁদের । ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে । বিএসএফ সীমান্তে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার ওয়াদা করলেও তারা তা মানে না । বাংলাদেশে ছাত্র - জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর ভারত বাংলাদেশ সীমান্তেও উত্তেজনার সৃষ্টি হয় । ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী ( বিএসএফ ) সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ , অনুপ্রবেশ ও গুলি করে বাংলাদেশিদের হত্যা নিয়ে এই উত্তেজনার সৃষ্টি হয় । তখন পূর্বনির্ধারিত বিজিবি - বিএসএফ মহাপরিচালক ( ডিজি ) পর্যায়ের সম্মেলন এক মাস পেছানো হয় । নয়াদিল্লিতে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার দিনব্যাপী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ।
সম্মেলনে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের নিহতের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিএসএফ মহাপরিচালকের প্রতি জোর আহ্বান জানান । ওই সম্মেলনে সীমান্তে বিএসএফের হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিজিবি তীব্র প্রতিবাদ জানায় । তবে ওই সম্মেলন শেষের এক সপ্তাহের মাথায় ২৮ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় বিএসএফের গুলিতে আল আমিন নামে এক যুবক নিহত হন । আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে , গত আগস্ট থেকে চলতি বছরের ১২ মার্চ পর্যন্ত সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ১২ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন । একই সময় বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে সীমান্তে অন্তত অর্ধশত বাংলাদেশি আহত হয়েছেন । এসব হত্যা , গোলাগুলি ও উত্তেজনার ঘটনায় বিজিবি ও বিএসএফ ২১ বার পতাকা বৈঠক করেছে ।
পাটগ্রাম
লালমনিরহাটের উপজেলার শ্রীরামপুর ইউনিয়ন সীমান্তে গত বছরের ( ২০২৪ ) ২৬ এপ্রিল বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারান আবুল কালাম ( ২৪ ) । ওই ইউনিয়নের ঝালঙ্গী ডাঙ্গাপাড়া সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দারা এখনো শঙ্কিত । নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন , ‘ সীমান্তের নিকটবর্তী এলাকা হওয়ায় চাষাবাদ করা জমিতে কাজ করতেও ভয় হয় । বর্তমান রাত দিন অনেক বিএসএফ সদস্য অস্ত্র হাতে বসে থাকেন । তাঁদের তুলনায় বিজিবি সদস্য অনেক কম , সীমান্তে টহলও কম দেন । বাড়িঘর , পরিবার ছেড়ে তো আমরা যেতে পারি না ।
আবুল কালাম মা মমতা বেগম ( ৫০ ) বলেন , “ আমার ছেলেকে বিএসএফ বিনা দোষে গুলি করে মেরেছে । ওরা ( বিএসএফ ) খুবই নিষ্ঠুর । বর্তমান সীমান্তে বসবাস করতে আমাদের মতো সবারই অনেক ভয় হয় । না জানি বিএসএফ আবার গুলি করে কাউকে মারে নাকি । চাঁপাইনবাবগঞ্জ কিরনগঞ্জে এবং
আঙ্গরপোতা - দহগ্রাম সীমান্তের শূন্যরেখায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের বিষয়টি তুলে ধরে সীমান্তে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করার উপায় খোঁজা হয় ওই সম্মেলনে । সে সম্মেলনে উভয় দেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ পরিদর্শকদলের পরিদর্শন ও যৌথ আলোচনার দলিলের ভিত্তিতে সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে যেকোনো স্থায়ী স্থাপনা এবং কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের ব্যাপারে একমত হয় দুই দেশ ।
প্রতিবেশী দুই দেশের সীমান্তের অস্থিরতা থেকে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মানুষকে নিরাপদ রাখতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে বিজিবি । এর মধ্যে সীমান্ত এলাকায় জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন প্রচার , টহল এবং নজরদারি বৃদ্ধি করেছে । সাগরে মাছ ধরার সময় এবং আসা - যাওয়ার পথে পার্শ্ববর্তী দেশের জলসীমা এড়িয়ে চলাসহ বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছে জেলেদের । জানতে চাইলে বিজিবি সদর দপ্তরের পরিচালক ( অপারেশন ) লে . কর্নেল এস এম শফিকুর রহমান গতকাল মঙ্গলবার আজকের পত্রিকাকে বলেন , ভারতীয় সীমান্তে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল , তা এখন নেই । তবে রাখাইন একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতির ভেতরে রয়েছে । তারপরও যত ঘটনা ঘটেছে , সেগুলোতে যাঁরা অপহৃত হয়েছিলেন , সেসব জেলেকে ফেরত আনা হয়েছে ।
লে . কর্নেল শফিকুর রহমান আরও বলেন , জেলেরা যাতে বাংলাদেশের জলসীমা অতিক্রম না করেন সে বিষয়ে তাঁদের সচেতন করা হচ্ছে । যাতে এ ধরনের ( অপহরণ ) ঘটনা আর না ঘটে সে জন্য বিজিবিসহ অন্যরা কাজ করছে । জেলা প্রশাসন ও বিজিবি শাহপরীর দ্বীপের ও টেকনাফের জেলেদের সঙ্গে একাধিকবার এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন । তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে যা যা করা দরকার বিজিবি তা করছে ।
[ প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন লালমনিরহাটের পাটগ্রাম প্রতিনিধি আজিনুর রহমান আজিম ]