Image description
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার । মূল নিয়োগকর্তা কাজ দিতে পারেন না , বেতনও পান না শ্রমিক । বেশি উপার্জনের আশায় অবৈধভাবে অন্য মালিকের কাজ করেন অনেকেই । অবৈধভাবে কাজ করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন শ্রমিক । ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় দেশের ।

সব নিয়মকানুন মেনে বৈধভাবেই কর্মী ভিসায় মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন নাজমুল ইসলাম । কিন্তু গিয়ে দেখেন নিয়োগকর্তা যে কাজের জন্য তাঁকে নিয়ে যান , সে রকম কোনো কাজই তাঁর কাছে নেই , মিলছে না কোনো বেতনও । ফলে বাধ্য হয়ে কুয়ালালামপুরে অন্য একজনের অধীনে নির্মাণ খাতে কাজ করছেন এই কর্মী । মালয়েশিয়ার আইনে এটি অবৈধ । শুধু নাজমুলই নন , তাঁর মতো বৈধ ভিসায় মালয়েশিয়ায় গিয়ে ‘ অবৈধভাবে ’ কাজ করছেন অসংখ্য প্রবাসী কর্মী । তাঁদের সঠিক সংখ্যা কত তা জানা না গেলেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন , নিয়োগকর্তার কোনো কাজ না থাকায় অবৈধভাবে অন্য কোথাও কাজ করছেন হাজার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি । মূলত কিছু অসাধু এজেন্ট ও স্থানীয় দালালদের খপ্পরে পড়ে এ দশা হয়েছে তাঁদের । বৈধ ভিসায় গিয়েও অবৈধভাবে কাজ করছেন— এমন কয়েকজন বাংলাদেশি কর্মীর সঙ্গে কথা হয় ।

পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা আজকের পত্রিকার কাছে অভিযোগ করেন , মালিকপক্ষ চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে কম বেতন দেয় , অতিরিক্ত সময় কাজ করায় এবং শ্রমিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে । ফলে তাঁরা নির্ধারিত মালিকের অধীনে কাজ করতে না চেয়ে অন্য জায়গায় কাজ খোঁজেন । আবার অনেকেই অন্য মালিকের অধীনে কাজ করেন , কারণ তাঁদের মূল নিয়োগকর্তার কাছে কোনো কাজই নেই ।

মালয়েশিয়ার জহুরবারুর বাংলাদেশি কমিউনিটির তথ্য বলছে , কর্মসংস্থানের অভাবে অনেক প্রবাসী শ্রমিক মূল মালিকের অধীনে কাজ করতে পারেন না । কারণ অনেক রিক্রুটিং এজেন্সি শ্রমিকদের ভুয়া তথ্য দিয়ে কর্মী ভিসায় মালয়েশিয়ায় পাঠায় । তাঁরা দেশটিতে পৌঁছে কাজ পান না । এ অবস্থায় জীবিকা নির্বাহের জন্য বাধ্য হয়ে তাঁরা অন্য প্রতিষ্ঠানে অবৈধভাবে কাজ করতে যান । মালয়েশিয়ায় এভাবে অবৈধভাবে কাজের পরিণতি ভয়াবহ । দেশটির অভিবাসন আইন অনুযায়ী , বৈধ ওয়ার্ক পারমিট থাকা সত্ত্বেও নির্ধারিত নিয়োগকর্তা ছাড়া অন্যত্র কাজ করা অবৈধ । এ কারণে পুলিশ ও ইমিগ্রেশন বিভাগের নিয়মিত অভিযানে অনেক শ্রমিক আটক হন এবং দেশে ফেরত পাঠানো হয় । অনেক শ্রমিক অবৈধভাবে কাজ করতে গিয়ে বেতন পান না , মালিকের হয়রানির শিকার হন , এমনকি প্রতারণারও শিকার হন । আইনগত সুরক্ষা না থাকায় তাঁরা এ ধরনের সমস্যার বিরুদ্ধে অভিযোগও করতে পারেন না । নিজ মালিকের অধীনে না থাকায় অনেক শ্রমিক চিকিৎসাসেবা পান না এবং শ্রম আইনের সুরক্ষাও ভোগ করতে পারেন না । ফলে কাজের পরিবেশে দুর্ঘটনা ঘটলে বা অসুস্থ হলে তাঁরা বিপদে পড়েন । বিশ্লেষকেরা বলছেন , এ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারের উচিত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর কার্যক্রম কঠোরভাবে

মনিটর করা , যাতে শ্রমিকেরা প্রতিশ্রুত কাজ পান । পাশাপাশি শ্রমিকদের অবৈধভাবে অন্যত্র কাজের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করতে হবে এবং প্রয়োজনে তাঁদের জন্য সুরক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে । যাঁরা মালিকের অধীনে কাজ পাচ্ছেন না , তাঁদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা দরকার । শুধু তা - ই নয় , অবৈধভাবে শ্রমিকদের অন্যত্র কাজ করতে উৎসাহিত করা এজেন্ট ও দালালদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে । বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ মালয়েশিয়ায় তথাকথিত ফ্রি ভিসার নামে যাঁদের পাঠানো হচ্ছে , তাঁরাই মূলত বৈধ ভিসায় অবৈধভাবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন । তাঁদের প্রত্যেকেই বিএমইটি থেকে ছাড়পত্র নিয়ে যাওয়ার পর দেখেছেন কোম্পানিটি নামসর্বস্ব । সেখানে কোনো কাজই নেই । ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা খরচ করে যাওয়ার পর তাঁরা যখন এমন পরিস্থিতিতে পড়েন , তখন বাধ্য হয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে বাধ্য হন , যা মূলত অবৈধ । ফলে তাঁদের অনেক কম বেতনে কাজ করতে হয় । চিকিৎসা , বিমাসহ সব ধরনের সুবিধা থেকেও তাঁদের বঞ্চিত হতে হয় । পাশাপাশি এভাবে কাজ করায় তাঁদের মনে সব সময় পুলিশের ভয়ও কাজ করে । এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের শ্রমবাজারকে শৃঙ্খলার মধ্যে ফিরিয়ে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে ।

বিষয়টি জানতে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে ( বিএমইটি ) যোগাযোগ করা হলে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন , মালয়েশিয়া থেকে কাজের যেসব চাহিদাপত্র আসে , তা দূতাবাস যাচাই- বাছাই করেই পাঠায় । প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মীর প্রয়োজন রয়েছে কি না , কর্মীদের বেতন দিতে পারবে কি না , সেগুলো দূতাবাস থেকে যাচাই করা হয় । পরবর্তী সময়ে রিক্রুটিং এজেন্সির আবেদনের ভিত্তিতে স্মার্টকাড দেয় বিএমইটি । বাংলাদেশ জনশক্তি , কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য বলছে , সৌদি আরবের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার মালয়েশিয়া । বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ বাংলাদেশি কর্মী মালয়েশিয়ায় কর্মরত । চার বছর পর ২০২২ সালে দেশটির শ্রমবাজার খোলার পর ওই বছর গিয়েছিলেন ৫০ হাজার ৯০ জন । ২০২৩ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৫১ হাজার ৬৮৩ জনে । গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে দেশটিতে যান ৯৩ হাজার ৬৩২ জন । আর চলতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় গেছেন ১ হাজার ৫৮৭ জন । জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশ অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের ( বায়রা ) একাধিক সদস্যের অভিযোগ , রাঘববোয়ালদের চক্রের কারণে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশি কর্মীরা নানা সমস্যায় পড়ছেন । নাম প্রকাশ না করার শর্তে বায়রার এক সদস্য বলেন , শ্রমিকদের বিদেশ যেতে সরকার ৮০

হাজার টাকা ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে । কিন্তু সিন্ডিকেটের কারণে জনপ্রতি সাড়ে ৫ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে । যেখানে ৫০ জনের কাজের জায়গা রয়েছে , সেখানে ৫০০ লোক নিয়েছে । ফলে সেখানে গিয়ে শ্রমিকেরা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন । প্রসঙ্গত , মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা লুটে নেওয়ার তথ্য এসেছে ‘ একটি উন্নয়ন বয়ানের ব্যবচ্ছেদ ' নামের শ্বেতপত্রে । ড . দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি গত বছর দেশের অর্থনীতি নিয়ে যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে , সেখানে এটি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে । শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে , মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে কর্মী পাঠিয়ে ১০০ রিক্রুটিং এজেন্সির চক্র দেড় বছরেই হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা । প্রায় পৌনে ৫ লাখ কর্মীর কাছ থেকে অতিরিক্ত এই অর্থ নিয়ে নিজেদের পকেটে ভরেছে চক্রটি । চাহিদার বেশি কর্মী পাঠানোর অভিযোগও রয়েছে । এই চক্রের সঙ্গে জড়িত হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের চার সংসদ সদস্যের নামও এসেছে । দুর্নীতি দমন কমিশন ( দুদক ) ইতিমধ্যে সাবেক চার এমপির বিরুদ্ধে মামলা করেছে । তাঁরা হলেন সাবেক মন্ত্রী ও এমপি আ হ ম মুস্তফা কামাল , নিজাম উদ্দিন হাজারী , বেনজীর আহমেদ এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল ( অব . ) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী । প্রথম তিনজন আওয়ামী লীগের এবং মাসুদ উদ্দিন জাতীয় পার্টির এমপি ছিলেন ।