Image description
৩০০ বেডের সেন্ট্রাল কারা হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ । বন্দিদেরও নার্স হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

দেশের ৬৮টি কারাগারে ৭০ হাজারের বেশি বন্দি রয়েছেন। তবে এই বন্দিদের জন্য সার্বক্ষণিক চিকিৎসাসেবা দিতে ডাক্তার রয়েছেন মাত্র দুজন। এই ডাক্তাররা দুটি কারাগারে দায়িত্ব পালন করছেন। বাকি ৬৬টি কারাগারে কোনো চিকিৎসক নেই।

কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মন্ত্রী-এমপিসহ শতাধিক ভিআইপি বন্দি রয়েছেন। এই কারাগারে বন্দির সংখ্যা আট হাজারের বেশি। এত বিপুলসংখ্যক বন্দির জন্য কারাগারটিতে সার্বক্ষণিক কোনো ডাক্তার নেই। কারা হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা চলছে ফার্মাসিস্ট ও নার্সদের দিয়ে। এই চিত্র শুধু বর্তমানের নয়, বহুদিন ধরে কারা হাসপাতালগুলোয় এই একই চিত্র বিরাজ করছে।

২০২১ সালের মার্চে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে লেখক মুশতাক আহমেদ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অচেতন হয়ে পড়লেও সেখানকার হাসপাতালে কোনো ডাক্তার ছিলেন না। খবর পেয়ে সেখানে যান একজন নার্স। তিনি গিয়ে অবস্থা খারাপ দেখে মুশতাক আহমেদকে বাইরের কোনো হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দেন।

এরপর তাঁকে পাঠানো হয় গাজীপুরের হাসপাতালে। কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছার আগেই তিনি মারা যান। ওই সময় বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়। তবে নিয়ম রয়েছে, কারাগারে কোনো বন্দি অসুস্থ হয়ে পড়লে সর্বোচ্চ ২০ মিনিটের মধ্যে একজন চিকিৎসক তাঁকে দেখে চিকিৎসা দেবেন। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, কোনো বন্দি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে ২০ ঘণ্টায়ও মেলে না চিকিৎসকের দেখা।

নার্স ও ওষুধ ভাণ্ডারের দায়িত্বরতরাই তখন তাদের চিকিৎসা দেন। এ ছাড়া ডাক্তার না থাকায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়া বন্দি রোগীদের বাইরের হাসপাতালে পাঠাতেও কারা কর্তৃপক্ষকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। ফলে বন্দি রোগীর তাত্ক্ষণিক চিকিৎসা অসম্ভব হয়ে পড়ে। বাইরের হাসপাতালে বন্দির পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থার আয়োজন এবং হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাওয়া নিয়েও রয়েছে নানা ধরনের অভিযোগ। অসাধু কিছু চিকিৎসক টাকার বিনিময়ে প্রভাবশালী বন্দিদের বিনা কারণে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে চিকিৎসা পরামর্শ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।

এ অবস্থায় একটি কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশেই করা হবে ৩০০ বেডের এই হাসপাতাল। তাতে থাকবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সব যন্ত্রপাতি। অন্যান্য সরকারি হাসপাতালের মতো এই হাসপাতাল থেকেও সাধারণ মানুষ চিকিৎসা সুবিধা পাবে। আর অসুস্থ কারাবন্দিদের অন্য কোনো হাসপাতালে পাঠানোর প্রয়োজন হবে না। 

আইজি প্রিজন্স ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন গত শুক্রবার রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ২০১৮ সালে কেন্দ্রীয় হাসপাতালটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। পরে উদ্যোগটি থেমে যায়। আমরা আবারও উদ্যোগটি সচল করার চেষ্টা করছি। এরই মধ্যে অনেক কাজ এগিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এরই মধ্যে কারারক্ষীদের নার্স হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। বন্দিদের মধ্য থেকেও নার্স তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাঁরা বিভিন্ন কারা হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করবেন। এরই মধ্যে ২০ জন কারারক্ষীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দিদের মধ্য থেকেও বাছাই করে নার্সের প্রশিক্ষণ দিতে কারা কর্তৃপক্ষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন চেয়েছে। অনুমোদন পেলেই বন্দিদের মধ্য থেকে প্রতি ব্যাচে ২০ থেকে ২৫ জন করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। 

জানা গেছে, ৬৮টি কারাগারে সার্বক্ষণিক যে দুজন চিকিৎসক রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কেউই হৃদরোগ বা স্নায়ু রোগের চিকিৎসক নন। অথচ কারাগারগুলোয় প্রায়ই বন্দিরা হৃদরোগ ও স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন। মানসিক চিকিৎসা দেওয়ার চিকিৎসকও নেই। কারাগারগুলোয় ৭০ হাজারের বেশি বন্দির মধ্যে ৪০ বছরের বেশি বয়সের বন্দির সংখ্যা অন্তত ৪০ হাজার। তাঁদের বেশির ভাগ নানা ধরনের রোগ-বালাইয়ে আক্রান্ত। এত বন্দির চিকিৎসায় কারাগারে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালনে মাত্র দুজন চিকিৎসক রয়েছেন। তাঁদের একজন মানিকগঞ্জে অন্যজন কাশিমপুর কারাগারে দায়িত্ব পালন করছেন। অথচ কারা হাসপাতালে চিকিৎসকের পদ রয়েছে ১৪১টি। এসব পদে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের ১০৬ জন চিকিৎসক সংযুক্ত রয়েছেন, যাঁদের প্রয়োজন হলে ডেকে আনতে হয়। তাঁরা সপ্তাহে দু-এক দিন কারাগারে গিয়ে চিকিৎসা দেন বলে জানা গেছে।

কারাগারে চিকিৎসক ও কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্ব 

এক কারা চিকিৎসক জানান, সাধারণ হাসপাতাল বা ক্লিনিকে কাজ করা আর কারাগারের হাসপাতালে কাজ করার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। কারাগারে অনেক প্রভাবশালী বন্দি থাকেন, যাঁরা বাইরের হাসপাতালে বা কারা হাসপাতালে থাকার চেষ্টা চালান। ফলে অনেক সময় বাধ্য হয়ে চিকিৎসকদের সংশ্লিষ্ট বন্দিকে হাসপাতালে রেফার করতে হয়। কারাগারের কিছু জেলার, ডেপুটি জেলার বন্দিকে হাসপাতালে পাঠানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ডাক্তারদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। ফলে বন্দিকে হাসপাতালে পাঠানোর দায়টি ডাক্তারকেও বহন করতে হয়। এ ছাড়া অনেক কারা কর্মকর্তা চিকিৎসকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। চিকিৎসা নিতে আসা বন্দিরাও গালাগাল করেন। এসব কারণে কারাগারে দায়িত্ব পালন করতে অনীহা রয়েছে ডাক্তারদের।

তবে একটি সূত্র জানায়, কারা চিকিৎসকদের কেউ কেউ টাকাওয়ালা কারাবন্দিদের কাছ থেকে আর্থিক সুযোগ নিয়ে তাঁদের অসুস্থ বলে হাসপাতালে রাখতে পরামর্শ দেন। ওই বন্দিরা হাসপাতালে গিয়ে স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎসহ বৈঠক পর্যন্ত করেন। এতে চাপে পড়তে হয় কারা কর্তৃপক্ষকে। অনেক ক্ষেত্রে অসুস্থ না হলেও চাপের কারণে প্রভাবশালী বন্দিকে হাসপাতালে রেফার করা নিয়ে কারা কর্মকর্তাদের সঙ্গে চিকিৎসকদের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এক কারা কর্মকর্তা জানান, কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল নির্মাণ শেষ হলে এসব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।