Image description
মানব পাচার » রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ভালো বেতনে চাকরির আশায় ফাঁদে পড়ছেন তরুণেরা । রাশিয়ায় গিয়ে বাধ্য হয়ে স্বল্প প্রশিক্ষণের পর ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামছেন । ১১ তরুণকে ঢাকার বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে । তরুণদের দালালদের মাধ্যমে জোগাড় করে রাশিয়ায় পাঠাচ্ছে একাধিক ট্রাভেল এজেন্সি । এক দালালকে গ্রেপ্তারের পর কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সির ওপর নজরদারি করছে প্রশাসন । যুদ্ধে তিনজনের প্রাণহানি , আহত কয়েকজন , অনেকের অবস্থান শনাক্ত হয়নি । এরপরও থামছে না রাশিয়া যাওয়া , ১১ তরুণকে বিমানবন্দর থেকে ফেরত ।

বিদেশে ভালো কাজের লোভ দেখিয়ে বাংলাদেশের তরুণদের এবার ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাশিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধা বানাচ্ছে মানব পাচারকারীরা । জনপ্রতি মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে তাঁদের সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ হয়ে নেওয়া হচ্ছে রাশিয়ায় । সেখানে জোর করে চুক্তিনামায় সই করিয়ে যোদ্ধা হিসেবে পাঠানো হচ্ছে যুদ্ধে । এ পর্যন্ত অন্তত ১০০ তরুণ এভাবে দেশটিতে গেছেন । তাঁদের মধ্যে তিনজন নিহত ও বেশ কয়েকজনের আহত হওয়ার খবরও এসেছে । বিষয়টি নজরে আসার পর ঢাকার হযরত শাহজালাল . . আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ আন্তর্জাতিক তিন বিমানবন্দরেই নজরদারি বাড়ানো হয় । কিন্তু এরপরও সোনার হরিণ ধরার স্বপ্নে বিভোর তরুণদের যুদ্ধের ফাঁদে পড়া ঠেকানো যাচ্ছে না । গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত রাশিয়াগামী সন্দেহে বিমানবন্দরগুলোয় বিশেষ সতর্কতা জারির অনুরোধ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় । ইতিমধ্যে ফাঁদে পড়ে রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধে যাওয়া ১০০ তরুণের কয়েকজনের অবস্থান শনাক্ত হলেও বাকিদের খোঁজ নেই ।

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আসা ও যুদ্ধাহত কয়েকজন দেশে ফেরার আকুতি জানিয়েছেন পরিবারের কাছে । পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের ( সিআইডি ) বিশেষ সুপার জসীম উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে গতকাল বলেন , রাজধানীর বনানী থানায় একটি মামলার তদন্তের অংশ হিসেবে এক দালালকে গ্রেপ্তার করা হয় , যিনি মানব পাচার চক্রের সদস্য । সন্দেহভাজন আরও দু - একটি ট্রাভেল এজেন্সিকেও নজরদারিতে রাখা হয়েছে । তিনি জানান , দালালদের এই ফাঁদ থেকে বাঁচতে সাধারণ মানুষকে সচেতন করারও চেষ্টা চলছে । কূটনীতিক , সিআইডি ও পুলিশের বিশেষ শাখার ( এসবি ) ইমিগ্রেশন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী , রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ভালো বেতনে চাকরির লোভ দেখিয়ে মানব পাচারকারীরা তরুণদের তৃতীয় দেশ হয়ে রাশিয়ায় নিচ্ছে । তাঁরা রাশিয়া গিয়ে চাপের মুখে ভাড়াটে যোদ্ধা বনে যাচ্ছেন । তাঁদের কেউ কেউ ওমরাহ ভিসায় সৌদি আরব , ভ্রমণ ভিসায় সংযুক্ত আরব আমিরাত , তুরস্কসহ তৃতীয় দেশ হয়ে রাশিয়ায় যাচ্ছেন । পরে তাঁদের চুক্তিনামায় স‍ই করিয়ে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ দিয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে ।

একজন পদস্থ কূটনীতিক বলেন , মানব পাচারকারীরা লোভ দেখিয়ে দুবাই , ইস্তাম্বুলসহ বিভিন্ন রুটে রাশিয়ার বিভিন্ন গন্তব্যে তরুণদের নিতে শুরু করেছে , এমন তথ্য গত বছর মে - জুনের দিকে স্বরাষ্ট্র ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয় । কিন্তু সরকার এ অনুরোধ আমলে নেয়নি । মানব পাচার ঠেকানোর বিষয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই । তিনি বলেন , মানব পাচারকারীদের তৎপরতার কথা প্রায় একই সময় মস্কোয় রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও জানানো হয় । ময়মনসিংহের গৌরীপুরের ইয়াসিন মিয়া শেখ গত বছর দালালের মাধ্যমে রাশিয়ায় গিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নেন । ঈদের পরদিন রাশিয়ায় থাকা এক পরিচিতজনের কাছ থেকে পরিবার জেনেছে , ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইয়াসিন নিহত হয়েছেন । নাটোরের সিংড়ার হুমায়ুন কবীরও নিহত হন । তাঁর ভগ্নিপতি রহমত আলী এখনো রাশিয়ায় আটকে রয়েছেন । পরিবারের দাবি , ওমরাহ ভিসায় সৌদি আরব নেওয়ার কথা বলে তাঁদের রাশিয়ায় নেওয়া হয় । সেখানে জোর করে প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধে পাঠানো হয় । রহমত আলীর স্ত্রী যমুনা বেগম দাবি করেন , রহমত ও হুমায়ুনকে রাশিয়ায় আড়াই লাখ টাকা বেতনে মালি ও কুকের চাকরির লোভ দেখানো হয় । দুজনের জন্য ১৮ লাখ টাকা জমা দিতে বললে তাঁর স্বামী ও ভাই জমি বিক্রি করে একটি প্রতিষ্ঠানে ( ট্রাভেল এজেন্সি ) ১৮ লাখ টাকা জমা দেন । তবে ২০২৪ সালের ১৮ অক্টোবর রহমত আলী ও হুমায়ুন কবীরকে ওমরাহ ভিসা করে দেওয়া হয় । প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয় , সৌদি আরবে ওমরাহ শেষে তাঁদের রাশিয়া নেওয়া হবে । সৌদি আরবে তাঁদের দুই মাস রেখে রাশিয়ায় নেওয়া হয় ।

আমিনুল ইসলামের স্ত্রী ঝুমু আক্তার আজকের পত্রিকাকে বলেন , তাঁর স্বামীকে যুদ্ধ করতে বাধ্য করেছে । তিনি যুদ্ধে আহত হয়ে পড়ে আছেন । সেখানে আরও বাংলাদেশি আছে । কিন্তু দেশে সেভাবে কোনো সহায়তা পাচ্ছেন না । কী করা উচিত বুঝতেও পারছেন না । তাঁর দাবি , এজেন্সিগুলো মিথ্যা বলে তাঁদের রাশিয়া পাঠিয়েছে । বনানীর ৪ নম্বর সড়কের একটি বাড়ির নিচতলার দুটি কক্ষ নিয়ে ‘ ড্রিম হোম ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস লিমিটেড ' - এর কার্যালয় । প্রতিষ্ঠানের মালিক এম এম আবুল হাসান কয়েক মাস ধরে কার্যালয়ে আসেন না বলে জানান ভবনের নিরাপত্তাকর্মী মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ । রাশিয়া - ইউক্রেন যুদ্ধে লোক পাঠানোর বিষয়ে শহীদুল্লাহ বলেন , যাঁরা গেছেন , তাঁরা সব জেনেশুনেই গেছেন । শুনেছেন , ওখানে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর তাঁদের ২০ লাখ টাকা করে দেওয়া হবে ।

প্রতি মাসে পরিবারের ভরণপোষণের জন্য টাকা পাঠানো হবে । এসব কথায় লোভে পড়েছেন অনেকে । তিনি শুনেছেন , কেউ কেউ নাকি প্রশিক্ষণ শেষে বাড়িতে টাকাও পাঠিয়েছেন । পুলিশের বিশেষ শাখার ইমিগ্রেশন বিভাগ জানায় , ভালো বেতনে চাকরির লোভ দেখিয়ে রাশিয়ায় নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর এবং হতাহতের খবর শুনেও কিছু তরুণ বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে রাশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করছেন । জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত সন্দেহভাজন ১১ জন তরুণকে বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে । রাশিয়ায় এমন শতাধিক তরুণ থাকতে পারেন বলে তাঁরা জেনেছেন । ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন , অভিবাসন বা মানব পাচার নিয়ে একাধিক সংস্থা কাজ করলেও কেউ দায় নিচ্ছে না । পুরো প্রক্রিয়াকে এক প্ল্যাটফর্মে এনে নেতৃত্ব নির্ধারণ করা জরুরি । শুরুতে এটি হলে এই শতাধিক তরুণ জীবনযুদ্ধে আটকা পড়তেন না । খোঁজ নিয়ে জানা যায় , প্রতিবেশী দেশ ভারত , নেপাল ও শ্রীলঙ্কার অনেক নাগরিককেও যুদ্ধের জন্য মানব পাচারকারীরা রাশিয়া নিয়ে সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেন । এই চক্রের কাছ থেকে পালিয়ে দেশে ফিরেছেন আকরাম হোসেন । তিনি যুদ্ধাহত আমিনুল ইসলামের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বনানী থানায় মামলা করতে সহায়তা করেন ।

যমুনা বেগম বলেন , রাশিয়ায় সেনানিবাসে নিয়ে তাঁর স্বামী ও ভাইকে জোর করে চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করিয়ে ২০ দিন যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় । পরিবারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে তাঁরা বারবার বাঁচানোর আর্তি জানান । তাঁর স্বামীই চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি গেছে । ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় হুমায়ুন নিহত হওয়ার খবর পরিবারকে তথ্য অনুযায়ী , বিদেশিরা বেতনের জানান ।

যশোরের জাফর হোসেনকে সাইপ্রাসে ভালো কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ৯ লাখ টাকা নিয়ে সৌদি আরব , দুবাই হয়ে রাশিয়ায় পাঠানো হয় । তিনি এখন যুদ্ধক্ষেত্রে আটকা পড়েছেন । প্রাণ নিয়ে সংশয়ের কথা জানিয়েছেন পরিবারকে ।

রুশ সূত্র থেকে পাওয়া বিনিময়ে যুদ্ধে যেতে চাইলে রাশিয়া লিখিত চুক্তির আওতায় নিয়োগ দেয় । মস্কোয় বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত মো . ফয়সাল আহমেদ আজকের পত্রিকাকে গতকাল বলেন , বাংলাদেশের যাঁরা যুদ্ধে গেছেন , তাঁদের ফেরত পাঠানোর জন্য রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কূটনৈতিক পত্র দেওয়া হয়েছে । বিষয়ে তৎপরতা চলছে ।

সিআইডি জানায় , বনানী থেকে তামান্না নামের এক নারীকে গ্রেপ্তার করা হয় । তাঁরা জেনেছেন , তিনি ‘ ড্রিম হোম ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস সংশ্লিষ্ট অন্য লিমিটেড ' নামের এজেন্সির অংশীদার কর্মকর্তা বলেন , যাঁরা আটকা এবং পাচারকারী চক্রের সদস্য । তাঁরা পড়েছেন , তাঁদের দেশে ফেরানোর ১০ জনকে ওমরাহ ভিসায় সৌদি প্ৰক্ৰিয়া অত্যন্ত জটিল আরব পাঠিয়ে পরে রাশিয়ায় বিক্রি দীর্ঘমেয়াদি । বরং যাঁরা রাশিয়ায় করে দেন । সেখান থেকে সুলতান আসার চেষ্টা করছেন , তাঁদের সচেতন নামের একজন তাঁদের রুশ করা জরুরি ।