Image description

শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর থেকে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও শেরপুর জেলার সীমান্ত এলাকাগুলোয় এক প্রকার আতঙ্কজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা এবং ভারতের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (র) এজেন্টরা এই সীমান্তকে নিরাপদ করিডোর হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও শেরপুর জেলার সীমান্ত ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত থাকায় বর্তমানে শুধু মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি, তুরা ও ডাউকি এলাকায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী অবস্থান করছেন। সীমান্তবর্তী বিভিন্ন বাজার ও জনপদে বসবাস করে তারা বাংলাদেশি মোবাইল সিমকার্ড ব্যবহার করে দেশের ভেতরে অবস্থানরত নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন।

স্থানীয় সূত্র ও গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, গত সাত মাসে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের অন্তত এক হাজার নেতাকর্মী দালাল, স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মী ও প্রশাসনকে হাত করে চুপিসারে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছেন। পালিয়ে যাওয়া এসব নেতার কেউ কেউ মাঝেমধ্যে বাংলাদেশে ফিরে এসে রাজনৈতিক ও পারিবারিক কাজ শেষ করে আবার ভারতে পালাচ্ছেন।

অন্যদিকে ভারতের দিক থেকে আসা পাগলবেশী অসংখ্য ব্যক্তিকে ময়মনসিংহের সীমান্ত এলাকায় দেখা যাচ্ছে। এদের অনেকেই হিন্দিতে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছেন। সীমান্তের স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, এসব প্রবেশকারী প্রকৃতপক্ষে মানসিক রোগী নাও হতে পারেন। বরং অন্য কোনো উদ্দেশ্যে তাদের সীমান্ত এলাকায় পাঠানো হয়েছে, যে কারণে ওই সব ব্যক্তির অস্বাভাবিক আচরণ সন্দেহের সৃষ্টি করেছে।

দালালদের রমরমা ব্যবসা

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে সীমান্ত দিয়ে মানব পাচার, মাদক ব্যবসা ও অবৈধ পণ্যের লেনদেন হয়েছে নির্বিঘ্নে। এ কারণে সীমান্তের দুই পারেই আওয়ামী বলয়ে গড়ে ওঠা দালাল ও চোরাকারবারি চক্র এখনো সক্রিয়। ফলে এ অঞ্চলে একটি শক্তিশালী চোরাচালান নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে, যারা বর্তমানে আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাদের পারাপারের জন্য দালাল সিন্ডিকেট হিসেবে রমরমা ব্যবসা শুরু করেছে।

তাদের মাধ্যমে একেকজন শীর্ষ নেতাকে সীমান্ত পাড়ি দিতে গুনতে হচ্ছে দুই কোটি টাকা। শুধু শীর্ষপর্যায়ের নেতারাই নয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের জন্যও নির্দিষ্ট ‘রেট’ নির্ধারণ করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে জেলাপর্যায়ের জন্য ৫০ লাখ ও উপজেলার নেতাকে গুনতে হচ্ছে ৩০ লাখ টাকা। আবার যেসব নেতা কিছুদিন পর ফিরে আসবেনÑ এমন প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তাদের ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থাও রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের হিসাবমতে, এই দালালচক্র সীমান্ত পারাপারের অবৈধ বাণিজ্য করে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তবে বিষয়টি শুধু দালালদের মধ্যেই সীমিত নেই, অনুসন্ধানে আরো ভয়ংকর তথ্য উঠে এসেছে।

বিএসএফের সম্পৃক্ততা

জানা গেছে, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) কিছু সদস্য মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে বিএসএফের সঙ্গে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করছে ভারতীয় সীমান্তের দালালচক্র।

তারা বাংলাদেশি দালালদের হয়ে কাজ করছে এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যাওয়া নিশ্চিত করছে। এ নিয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ও প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। সীমান্তের অবৈধ এ কার্যক্রম জাতীয় নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। প্রশাসনের কার্যকর তৎপরতা না থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা।

হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া সীমান্ত দিয়ে পলায়ন

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, হালুয়াঘাটের ভুবনকুড়া ইউনিয়নের ধনভাঙ্গা গ্রামের সীমান্ত দিয়ে নদীপথে ভারতের গাছুয়াপাড়া ও কাটাবাড়ী এলাকা দিয়ে ভারতে প্রবেশ করছেন আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী। এ উপজেলার সীমান্ত দিয়েই শামীম ওসমান, তার স্ত্রী সালমা লিপি ও ছেলে অয়ন ভারতের আসাম রাজ্যে প্রবেশ করেন। পরে পরিবারের সবাই একত্রিত হয়ে কলকাতা হয়ে দিল্লি যান এবং ৬ সেপ্টেম্বর দিল্লির নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার মাজারে শামীম ওসমানের উপস্থিতি দেখা যায়। সর্বশেষ দুবাইয়ে নিজ বাড়িতে অবস্থান নিয়েছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হালুয়াঘাট সীমান্ত এলাকার দালাল শফিক মিয়া ও শামীম গত সাত মাসে কমপক্ষে ২০০ জনকে অবৈধ পথে সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাঠিয়েছেন। এমনকি এই প্রতিবেদককে কাস্টমার মনে করে শফিক মিয়া মোবাইল ফোনে বলেন, ‘যেকোনো সময় চলে আসেন, ভারতে পাঠানো যাবে।’

অন্যদিকে, গত বছরের ৬ আগস্ট ধোবাউড়া উপজেলার সীমান্ত দিয়ে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি জুয়েল আরেং, গফরগাঁওয়ের আলোচিত সাবেক এমপি ফাহামি গোলন্দাজ বাবেল ওরফে ছোট গোলন্দাজ, ময়মনসিংহ সদরের সাবেক এমপি মোহিত উর রহমান শান্ত ওরফে জঙ্গি শান্ত, ফুলপুর-তারাকান্দার এমপি শরিফ আহম্মেদ, আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য অসীম কুমার উকিল ও তার স্ত্রী সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অপু উকিল দেশ ছেড়েছেন।

এমনকি তাদের দেশত্যাগের পর ময়মনসিংহের একজন সাংবাদিক ভারতে গিয়ে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে গত বছরের অক্টোবরের শেষের দিকে দেশেও ফিরেছেন। ওই সাংবাদিক দেশে ফিরে আওয়ামী ঘরনার সাংবাদিক ও ‘র’-এর এজেন্টদের সঙ্গে মিটিং করেন এবং আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়নে এখনো রাষ্ট্রবিরোধী গোপন ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন।

এ ছাড়া ৮ আগস্ট মুন্সিপাড়া বিজিবি ক্যাম্পের সামনে দিয়ে কড়ইগড়া সীমান্ত এবং ধোবাউড়ার দক্ষিণ মাইজউড়া এলাকা দিয়েও বহু নেতাকর্মী ভারতে পালিয়েছেন বলে খবর রয়েছে। শুধু তাই নয়, গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর স্থানীয় একটি দালাল সিন্ডিকেটকে দুই কোটি টাকা দিয়ে ভোররাতে ধোবাউড়া সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢোকার চেষ্টা করেন একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী মোজাম্মেল হক বাবু এবং দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকার সম্পাদক শ্যামল দত্ত। কিন্তু টাকা ভাগাভাগির একপর্যায়ে প্রতিপক্ষ আরেকটি চক্র হট্টগোল শুরু করলে স্থানীয় লোকজন তাদের সীমান্তবর্তী দর্শা খোলা মাঠে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে।

গত বছরের নভেম্বরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও ধোবাউড়া সীমান্ত দিয়ে মেঘালয়ের তুরায় পৌঁছান বলে জানা গেছে। এরপর তিনি ভারতের আসাম রাজ্যের গোহাটিতে কয়েকদিন অবস্থান করেন বলেও স্থানীয় দালালচক্রের একজন জানিয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক রাজনীতিবিদ জানান, গত বছরের আগস্টের শেষদিকে নেত্রকোনা-১ আসনের সাবেক এমপি মোশতাক আহমেদ রুহী, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও ময়মনসিংহ বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলসহ আরো কয়েকজন আকস্মিক কলমাকান্দা এলাকায় হাজির হন।

পরে সেখানকার প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে হাত করে তারা সীমান্ত অতিক্রম করেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের ভারতে পৌঁছে দিয়েছেন, এমন আন্তঃদেশীয় দালালচক্রের সদস্য হিসেবে সমনিয়াপাড়ার আব্দুস সাত্তার, নলকুড়া গ্রামের বিল্লাল মেম্বার ও হরমুজ, কুঁচপাড়া গ্রামের মাইনু, শাপলা বাজারের সিরাজুলসহ বেশ কয়েকজনের নাম বিজিবির তালিকায় আছে।

দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা সীমান্ত ব্যবহার

নেত্রকোনার দুর্গাপুর ও কলমাকান্দার সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাতায়াতের প্রবণতা ভয়াবহভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে সোমেশ্বরী নদী ও সীমান্তবর্তী এলাকার কিছু অংশে বিজিবির নিয়ন্ত্রণ সীমিত থাকা এবং সীমান্ত এলাকার অনেকাংশে অবৈধ কাঁটাতারের বেড়া না থাকায় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা এই পথকে নিরাপদ রুট হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এতে সীমান্তপথে অবৈধ যাতায়াত নতুন মাত্রা পেয়েছে, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠছে।

স্থানীয় রফিকুল ইসলাম জানান, দালালদের লেনদেন নিশ্চিত হয়ে বিএসএফও সীমান্তের গেটগুলো অনেক সময় খুলে রাখে, যে কারণে এ রুটগুলো এখন দালালদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।

কলমাকান্দা উপজেলার লেংগুরা ও খারনৈ সীমান্ত হয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ভারতে যাতায়াত করছেন। বিশেষ করে ১১৭৫ ও ১১৭৬ নম্বর পিলারসংলগ্ন স্থানে অবস্থিত রিং কালভার্টের ভেতর দিয়ে দালালদের সহায়তায় ভারতে প্রবেশের ঘটনা বাড়ছে।

স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, এই অবৈধ যাতায়াতে হৃদয় নামে এক সুপারি ব্যবসায়ী মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দালালদের সহযোগিতা করছেন।

শেরপুরের গারো পাহাড়ের গোপন রুট

শেরপুরের শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী সীমান্ত অঞ্চলের প্রায় ৪০ কিলোমিটার এলাকায় বিস্তৃত গারো পাহাড় এখন আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাদের জন্য ‘নিরাপদ করিডোর’ হয়ে উঠেছে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পোড়াকাশিয়া সীমান্তঘেঁষা এ এলাকায় ৫০টির বেশি গ্রাম রয়েছে। এ অঞ্চলের অরক্ষিত গারো পাহাড়ের খোলা অংশ ও বিশেষ কালভার্টের ফাঁক ব্যবহার করে ভারতে পালাচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।

সরেজমিন স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শ্রীবরদী ও ঝিনাইগাতী উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোর পাশেই ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পোড়াকাশিয়া এলাকা। এখানেই সীমান্ত পিলারের জিরো পয়েন্টে ভারতের কাঁটাতারের বেড়ার নিচে গোলাকৃতির কালভার্টের ফাঁক রয়েছে, যা গোপন পথে যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে।

এ ছাড়াও কাঁটাতারের বেড়া শেষ হওয়ার পর রয়েছে খোলা অংশ, কোথাও নদী, কোথাওবা নদীর ওপর ব্রিজ। তথ্য অনুযায়ী, শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার খারামোরা গ্রামটি ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা হওয়ায় এদিক দিয়েই আওয়ামী লীগের নেতারা পাড়ি দিচ্ছেন ভারত সীমান্ত। অপরদিকে শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের তাওয়াকুচা টিলাপাড়া সীমান্ত দিয়ে অসংখ্য আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ভারতে প্রবেশ করেছেন। এ রুটগুলো এতটাই গোপনীয় যে, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নজরদারি এড়িয়ে রাতের আঁধারে এখানে চলাচল করা সহজ হয়ে উঠেছে।

কলকাতা, শিলং ও ত্রিপুরায় অবস্থান নেতাদের

সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল, সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবীর নানক, আব্দুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, এসএম কামাল হোসেন, শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাবেক উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি গাজী মেজবাউল হোসেন সাচ্চু ও সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান বাবু এবং ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদার, মাহমুদুল হাসান রিপন ও বর্তমান সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালি আসিফ ইনান কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অবস্থান করছেন।

কলকাতার সল্টলেক সিটি শপিংমল, নিউ মার্কেট ও কেষ্টপুর এলাকায় এসব নেতাকর্মীকে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে বলে জানা গেছে। কেউ কেউ আবার শিলিগুড়ি, রামগঞ্জ ও দিল্লির নিরিবিলি এলাকায় বাসা বা হোটেল ভাড়া করে সময় কাটাচ্ছেন। কলকাতার বিখ্যাত স্টারবাক্স কফিশপ ও বিভিন্ন চায়ের দোকানে তাদের নিয়মিত আড্ডার খবরও মিলেছে।

কেউ কেউ সিনেপ্লেক্সে গিয়ে সিনেমা দেখছেন। কিছু নেতার বিরুদ্ধে ‘বেপরোয়া জীবনযাপনের’ অভিযোগও উঠেছে। টাঙ্গাইলের ছোট মনির একবার সল্টলেকের একটি অভিজাত বারে বিশৃঙ্খলা তৈরি করলে পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে হয়Ñ এমন খবর দিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।

প্রশাসনিক দপ্তরে আ.লীগের প্রভাব ও ষড়যন্ত্র

শেখ হাসিনার পলায়নের পর ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, রেঞ্জ ডিআইজি অফিস, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ বিভিন্ন প্রশাসনিক দপ্তরে এখনো পতিত আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির বেশকিছু নেতা প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করছেন। অনেকেই আবার হত্যা মামলাসহ সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় জামিনে বের হয়ে সামজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ সামাজিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থেকে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পক্ষে সাফাই গাইছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্টের পর যেসব নেতা ভারতে প্রবেশ করেছিলেন, তাদের কেউ কেউ ডেভিল হান্ট পরিচালনার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে ফিরে আসছিলেন। তবে ডেবিল হান্ট পরিচালনার পর ময়মনসিংহ অঞ্চলের বহু নেতাকর্মী আবারও ভারতে ঢুকেছেন। অন্যদিকে, কিছু প্রভাবশালী নেতা এখনো ময়মনসিংহের বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতাল ও ব্যক্তিগত বাসায় আত্মগোপনে রয়েছেন।

আবার ময়মনসিংহে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও গুলি চালানোর ঘটনায় জড়িত অনেকেই প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করছেন। বিশেষ করে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের পেছনের রাজবাড়ী রোড এলাকার শাহী মসজিদের পাশে অবস্থিত একটি বহুতল ভবনে বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা আত্মগোপনে রয়েছেন।

অন্যদিকে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা শহরে দাপটের সঙ্গে ঘোরাফেরা করছেন। তারা পলাতক সাবেক এমপি মোহিত উর রহমান শান্তর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। এমনকি বিভিন্ন রাজনৈতিক পোস্টার ডিজাইন করে শান্তর কাছে পাঠাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, তার প্রতিষ্ঠানে রাতে আওয়ামী লীগ নেতাদের আড্ডা চলে বলেও নিশ্চিত হওয়া গেছে।

ভারতীয় নাগরিক ও ‘র’-এর তৎপরতা

ময়মনসিংহে ভারতীয় নাগরিকদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে পাওয় তথ্যমতে, জেলায় ৬৪৩ জন বিদেশি নাগরিক বসবাস করছেন, যাদের মধ্যে ২৫০ জন ভারতীয়, ৬০ জন মালয়েশিয়ান এবং ৬০ জন চীনা রয়েছেন। অনুসন্ধানে দেখা যায়, আয়কর ফাঁকি দিয়ে অনেক ভারতীয় নাগরিক এ-থ্রি ও বি-ভিসা কিংবা ট্যুরিস্ট ভিসায় ময়মনসিংহে এসে কাজ করছেন। বিশেষ করে ভারতীয় নমনীয় ঋণের আওতায় তথ্য-প্রযুক্তি বিভাগের আওতাধীন ময়মনসিংহ হাইটেক পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ার পর থেকেই ময়মনসিংহে ভারতীয় নাগরিকদের যাতায়াত বেড়ে যায়।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার দাবি, ময়মনসিংহ হাইটেক পার্ককে কেন্দ্র করে অংসখ্য ভারতীয় নাগরিকের আনাগোনা বাড়ছে ময়মনসিংহে। শুধু তাই নয়, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর এজেন্টরাও ময়মনসিংহে তৎপর। জেলায় সংস্থাটির এজেন্ট ও ইনফরমার হিসেবে সক্রিয় রয়েছেন বেশকিছু প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সাংবাদিক, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও আইনজীবী। পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের তথ্যেও ‘র’-এর এজেন্ট হিসেবে কয়েকজন সাংবাদিকের নাম রয়েছে।

অন্যদিকে সোশ্যাল প্ল্যাটফরমে শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলতে উৎপল কর নামে এক ব্যক্তি ভারতীয় ‘র’-এর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন, যা এখন টক অব দ্য টাউনে পরিণত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিনিয়িত রাষ্ট্রবিরোধী গুরুতর উসকানি দিলেও উৎপল কর এখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরাছোঁয়ার বাইরে।

জানা গেছে, উৎপল কর ময়মনসিংহ বিভাগের ৫০ জনকে নিয়ে একটি টিম গঠন করেছেন। তাদের কাজ হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়ানো।

স্থানীয় প্রশাসনের নীরবতা ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দৃশ্যমান নিষ্ক্রিয়তা মানুষকে আরো সংশয়ে ফেলছে।

সুশীল সমাজ ও সাধারণ মানুষের মতে, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক টানাপড়েনের সময় যে প্রেক্ষাপটেই ঘটুক না কেন, সীমান্ত দিয়ে গোপন যাতায়াত দেশের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে এ প্রবণতা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

নেত্রকোনার দুর্গাপুর সীমান্ত এলাকার হাসিবুল ইসলাম বলেন, ‘শেখ হাসিনার পলায়নের পর থেকে সীমান্ত দিয়ে অহরহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের যাতায়াত করতে দেখা যাচ্ছে। আগে দেখতাম রাতের অন্ধকারে চোরাচালান হতো কিন্তু এখন দেখছি ব্যাগ হাতে মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে যাচ্ছেন। মাঝেমধ্যে ফিরেও আসছেন। এটাকে আমরা কী বলব? অনেকের সন্দেহÑ নিশ্চয়ই কোনো রাজনৈতিক পরিকল্পনা অথবা প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় এসব চলছে।’

এ ব্যাপারে পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য মানবাধিকারকর্মী এএসএম নাসির উদ্দিন এলান আমার দেশকে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির জটিলতায় আওয়ামী লীগ নেতাদের অবৈধভাবে ভারতে যাতায়াত নতুন করে উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে সীমান্ত এলাকা এমনিতেই স্পর্শকাতর। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতাদের অবৈধ পথে এ ধরনের যাতায়াত কঠোর নজরদারির মধ্যে না আনলে তা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এজন্য সীমান্তরক্ষী বাহিনীর আরো সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন তিনি।

এ ব্যাপারে ময়মনসিংহ ৩৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মুহাম্মাদ সানবীর হাসান মজুমদার আমার দেশকে বলেন, ‘অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে ভারত-বাংলাদেশের দালালদের সহায়তায় অনেক অপরাধী ভারতে পালিয়েছেন। সেজন্য অন্যান্য সময়ের তুলনায় বর্তমানে টহল বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশের দালালচক্রকে শক্ত হাতে দমনে সীমান্ত এলাকায় বিজিবির কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।’