
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে সবশেষ যেই দেশ সফর করেছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সেই দেশেই সরকারপ্রধান হিসেবে প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে যাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। আগামী ২৬ মার্চ শুরু হচ্ছে তার চার দিনের চীন সফর।
আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি ভারত নির্ভরতার অভিযোগ থাকলেও তাদের টানা চার মেয়াদে চীনের সাথে সখ্য বজায় রেখে চলতে দেখা গেছে বাংলাদেশকে।
বিশেষ করে বড় অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পগুলোতে চীনের সম্পৃক্ততা ও বিনিয়োগ ছিল উল্লেখযোগ্য।
তবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে সেই সম্পর্কের গতিতে ‘একটা ছেদ পড়ে’ উল্লেখ করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ‘নতুন করে গতি আনা প্রয়োজন’ বলে মনে করেন চীনে দায়িত্ব পালন করা বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ।
সফরের তৃতীয় দিন ২৮ মার্চ বেইজিংয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সাথে বৈঠক করার কথা রয়েছে মুহাম্মদ ইউনূসের।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর হওয়াটাই একে বিশেষভাবে তাপর্যপূর্ণ করে তুলেছে।
প্রধান উপদেষ্টার সফরটি ভূ-রাজনীতিতে ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক হতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে প্রতিবেশী ভারতের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে।
আবার যুক্তরাষ্ট্রের বিগত বাইডেন প্রশাসনের সাথে অন্তর্বর্তী সরকারের সৌহার্দ্য দৃশ্যমান হলেও এ ব্যাপারে বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি এখনো স্পষ্ট নয়।
একদিকে ভারতের সাথে চীনের আঞ্চলিক আধিপত্যের প্রশ্নে বৈরিতা রয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের বৈরিতা বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে যা ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর আরো ঘনীভূত হয়েছে।
সে কারণে চীনে মুহাম্মদ ইউনূসের সফর প্রতিবেশী ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কে কী প্রভাব রাখবে তা নিয়েও আলোচনা আছে।
তবে সব আলোচনা ছাপিয়ে এই সফর থেকে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা অধিকতর বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন গত রোববার গণমাধ্যমকে জানান, প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন চীন সফরে দেশটির সাথে কোনো চুক্তি সই হচ্ছে না। তবে কয়েকটি সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে।
সাবেক কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ‘মেয়াদের সীমাবদ্ধতার’ কারণে বড় চুক্তির মতো কোনো পদক্ষেপ না আসাই স্বাভাবিক।
তবে এই সরকারের সময়ে হওয়া সমঝোতা কিংবা প্রাথমিক উদ্যোগকে পরবর্তী সরকারগুলো এগিয়ে নেয়ার পথ তৈরি হবে।
কূটনৈতিক প্রভাব
বাংলাদেশে গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরের গন্তব্য বরাবরই ছিল নয়াদিল্লি।
কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর হয় চীনে, গত জানুয়ারিতে।
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে চীন। এ বছর দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্ণ হতে চলেছে।
ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন এর মতে, ৫০ বছর পূর্তিকে সামনে রেখে অধ্যাপক ইউনূসের সফর হবে একটি মাইলফলক।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সম্প্রতি জানান, এই সফরের মধ্য দিয়ে দু’দেশের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
কূটনৈতিকভাবে প্রধান উপদেষ্টার সফরটি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার ঠিক এক মাস আগে ৮ জুলাই বেইজিং সফরে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১১ জুলাই সফর শেষ করার কথা থাকলেও এক দিন আগে দেশে ফেরেন তিনি। সফরে ২১টি সমঝোতা স্বাক্ষর সই হয়।
ওই সফরের আগে ধারণা করা হচ্ছিল, তিস্তা প্রকল্প, রোহিঙ্গা সমস্যা, বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক সঙ্কট সমাধানের বিষয়ে চীনের ঋণ পেতে আলোচনা হবে।
কিন্তু সফরের শেষে দু’দেশের দিক থেকে যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হয় সেখানে তিস্তা মহা-পরিকল্পনা নিয়ে কোনো কথা ছিল না। বাণিজ্য, বিনিয়োগ কিংবা অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে চীনের দিক থেকে বড় কোনো প্রতিশ্রুতিও দেখা যায়নি।
চীনের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে সে দেশে দায়িত্ব পালনকারী সাবেক বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ বলেন, ‘শুরুটা চীন দিয়ে হয়েছে, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সব দেশের সাথেই সম্পর্ক ঝালিয়ে নিতে হবে। যেহেতু এটা দিয়ে শুরু হয়েছে এর একটা বাড়তি গুরুত্ব দিতেই হবে। নতুন সরকার আসার পর সরকারের জন্য এটা প্রতিষ্ঠা করা গুরুত্বপূর্ণ যে সবার সাথে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।’
বাংলাদেশে তিস্তা নদীকে ঘিরে চীনের অর্থায়নে একটি মহাপরিকল্পনার ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরে নানা কথাবার্তা শোনা গেলেও এ সফরে তেমন বড় কোনো ঘোষণা আসার সম্ভাবনা দেখেন না বিশ্লেষকরা।
মুন্সী ফয়েজ আহমদ বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। কোনো সহযোগিতার বিষয়ে এগোলে এই কথাটা মাথায় রেখেই এগোতে হবে অন্যপক্ষকে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দা রোজানা রশীদের মতে, রাজনৈতিক দিক থেকে এই সফরের একটা ‘সিম্বলিক ভ্যালু’ (প্রতীকী গুরুত্ব) আছে।
তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের যে দায়িত্ব তা যদি তারা পূরণ করতে পারে, নির্বাচিত সরকারও এটা ক্যারি অন (এগিয়ে নিতে) করতে পারবে। আর, দেশের বাইরেও এটা একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে।’
আঞ্চলিক আধিপত্যের বিচারে সীমান্তসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ভারত ও চীনের মধ্যে বৈরিতা আছে। কিন্তু, রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্বসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাদের মধ্যে মতৈক্যও দেখা যায় বলে মত অধ্যাপক রোজানা রশীদের।
তিনি আরো বলেন, ‘এমনকি মাল্টিল্যাটারাল (বহুপক্ষীয়) ইস্যুতে ভারত-চীন কখনো কখনো পরস্পরকে সহায়তাও করে।’
অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের আধিপত্য বাড়ানো ও পরস্পরের উপস্থিতি প্রতিহত করতে প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন।
তার সাথে যোগ হয়েছে, মিয়ানমার পরিস্থিতি। যেখানে চীনের প্রভাব অন্যদের তুলনায় বেশি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: বায়েজিদ সরোয়ার বলেন, অধ্যাপক ইউনূসের ব্যক্তিগত গ্লোবাল ইমেজ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ চীন সফরে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
বায়েজিদ সরোয়ার বলেন, ‘তবে চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে নতুন স্নায়ু যুদ্ধের বাস্তবতাও বিবেচনায় রাখা উচিত। সাম্প্রতিককালে মিয়ানমারের রাখাইনে পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সেখানে আরাকান আর্মি বেশিভাগ এলাকা দখল করেছে। আঞ্চলিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা ঝুঁকি আসতে পারে এই রাখাইন থেকে।’
মুন্সী ফয়েজ আহমদ বলেন, ‘দ্বিপক্ষীয় সফরের প্রস্তাব অন্য কারও দিক থেকে এলে সরকার সেটা নিশ্চয়ই গ্রহণ করতো। চীন আমন্ত্রণ জানিয়েছে, তাদের প্রস্তাবে সায় দিয়েছে সরকার। সম্পর্কটা এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। তার মানে এই নয় যে আমরা একদিকে ঝুঁকে যাচ্ছি।’
অধ্যাপক রোজানা রশীদ বলছেন, ‘চীনের রাষ্ট্রদূতের কথায় স্পষ্ট যে তারা সহায়তা করতে চান। বাংলাদেশ অন্যদের সাথে ব্যালান্স করেই তার স্বার্থ বজায় রাখার চেষ্টা করবে। কস্ট-বেনিফিট অ্যানালাইসিস করলে বেনিফিটটাই বেশি হবে বলে আমি মনে করি।’
অধ্যাপক ইউনূস এমন সময়ে বাংলাদেশের দায়িত্ব নিয়েছেন যখন দেশটির অর্থনীতি নানামুখী চাপে রয়েছে। ফলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দেয়া অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে তার সরকারের জন্য।
বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় চীনের মতো বড় ও স্থিতিশীল অর্থনৈতিক সহযোগীর আনুকূল্য প্রয়োজন, বলছেন বিশ্লেষকরা।
এর আগে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, চীনের সাথে সম্পর্কে বাংলাদেশ বাণিজ্য ও বিনিয়োগকেই গুরুত্ব দেবে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম গত ১৬ মার্চ এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘গত ৫ আগস্টের পর চীনের প্রতিষ্ঠানগুলো খুব ভালোভাবে ব্যবসা করছে। আমরা চাই তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে আরো বেশি বিনিয়োগ করবে।’
চীনের বড় কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও কারখানা স্থাপনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করবে বলে আশা করছেন তিনি।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তার চীন সফরে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে চীনের ঋণ পরিশোধের সময়সীমা ৩০ বছরে নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন।
এছাড়া ঋণের সুদের হার দুই-তিন শতাংশ থেকে এক শতাংশে নামিয়ে আনার আহ্বানও জানিয়েছিলেন তিনি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সফরে আলোচিত বিষয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে বৈঠকেও আলোচিত হবে বলে ধারণা করা যায়।
‘২০২৬ এ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে গেলে চীনে যে শুল্ক সুবিধা পাওয়া যায়, তা আরো তিন বছরের জন্য বাড়তি পাওয়া যায় কি না’ সেদিকেও অন্তর্বর্তী সরকারের নজর থাকবে বলে মনে করেন তিনি।
এছাড়া, ‘চীনের থেকে বিপুল পরিমাণ আমদানির ক্ষেত্রে ডেফারড্ পেমেন্ট (বিলম্বে পরিশোধ) সুবিধা পাওয়া যায় কি না, সেটাও আলোচনায় থাকার কথা,’ যোগ করেন মোস্তাফিজুর রহমান।
এই উদ্যোগ গৃহীত হলে বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কটে থাকা বাংলাদেশের জন্য তা স্বস্তির কারণ হবে।
কারণ, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চীনের আমদানি ব্যয় মেটাতে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য নতুন ঋণ বা সমঝোতায় পৌঁছানো গেলে সেটিও ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
চীন সফরের দ্বিতীয় দিনে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া অ্যানুয়াল কনফারেন্সের উদ্বোধনী অধিবেশনে যোগ দেবেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা।
সফর শেষে ২৯ মার্চ অধ্যাপক ইউনূসের দেশে ফেরার কথা রয়েছে। ততদিনে এই সফর থেকে বাংলাদেশের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
সূত্র : বিবিসি