Image description

যুদ্ধবিধ্বস্ত অবকাঠামো আর শূন্য ভান্ডার নিয়ে যাত্রা করা বাংলাদেশ এখন আর সে অবস্থায় নেই। নানা চড়াই-উতরাইয়ে অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া বাংলাদেশ বেশ কিছু ক্ষেত্রে এগিয়েছে সাফল্য দেখিয়ে। কিন্তু পাঁচ দশকের বেশি সময় পরও সত্যিকার সুশাসনের ছিটেফোঁটাও আসেনি দেশে। একের পর এক সরকার দেশ শাসন করলেও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কেউই। বরং শাসকগোষ্ঠীর ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের কারণে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর এসেও রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে বিশৃঙ্খলা। ফলে রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করা বিশ্বের গুটিকয় দেশের অন্যতম বাংলাদেশের জন্য সুশাসন নিশ্চিত করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্লেষকরা বলছেন, সুশাসন শুধু আইনশৃঙ্খলার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটা সব ক্ষেত্রের। সামগ্রিক সুশাসনের অভাবেই এখনো আসেনি প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক শৃঙ্খলা। ফলে উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছায় না। এ কারণে যে বৈষম্য দূর করতে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন, সেই ধনী-গরিব ও উঁচুনিচুর বৈষম্য এখনো বাড়ছে হুহু করে। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণায় বলা আছে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে। তখন মুক্তিকামী মানুষের স্বপ্ন ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে অন্যায়-অবিচার ও বৈষম্য থেকে মুক্তি ঘটবে। সমৃদ্ধ, সুখী ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পথচলা মসৃণ হবে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার বেড়েই চলেছে। গত কয়েক দশকে অনেকেই আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়েছে। কোনো সরকারই দিতে পারেনি মানুষের বাকস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বা ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতার নিশ্চয়তা। আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কোনো শৃঙ্খলা নেই। ব্যাংক-বিমা থেকে সব সরকারের আমলেই হচ্ছে হরিলুট। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো এর বিচার করতে পারছে না কারণ সেগুলোতেও নেই কোনো শৃঙ্খলা।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বাংলদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সুশাসন মানে ন্যায়বিচার, আইনের শাসন। সুশাসন মানে স্বচ্ছতা-জবাবদিহি। এ সবকিছুতেই আমরা পেছনে পড়ে গেছি। সুশাসনের পরিবর্তে আমরা দুঃশাসনে ধাবিত হয়েছি। এজন্যই গণ অভ্যুত্থান, ফ্যাসিবাদ ক্ষমতাচ্যুত করা, সহিংসতা। যে আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশা নিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, সেই সাম্য, মানবিক মর্যাদাবোধ ও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই এখন সবার প্রত্যাশা। নতুন কিছুর প্রত্যাশা থেকেই এ অভ্যুত্থান, এত রক্ত দেওয়া। শুধু রক্ত দেওয়াই নয়, বহুরকমের আত্মত্যাগ করেছে তারা। বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ৫৪ বছরে কেউ কথা রাখেনি। আমাদের যার যা করার কথা ছিল আমরা তা করিনি। মানুষের কল্যাণে নিষ্ঠার সফঙ্গ যেভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার কথা ছিল তা হয়নি। আমাদের রাজনীতি ব্যবসায়ীকরণ হয়ে গেছে। ব্যবসা রাজনীতিকরণ হয়ে গেছে। আমলারা জনগণের কল্যাণের পরিবর্তে নিজেদের কল্যাণ করেছে। এভাবে সব ক্ষেত্রে জনগণের কল্যাণের পরিবর্তে নিজেদের কল্যাণে যুক্ত হয়ে পড়েছি, নানানরকম অপকর্মে যুক্ত হয়ে পড়েছি। এ ক্ষেত্রে আমাদের রাজনীতিকদের ব্যর্থতা রয়েছে অবশ্যই, পাশাপাশি অন্যরাও ব্যর্থ হয়েছে। কেউ নিজের দায় এড়াতে পারবে না।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, স্বাধীনতার পর আমাদের অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু বিগত ১৬ বছরে আমরা একটি সরকারের ভূমিকা দেখেছি। তাদের ভূমিকা মানুষকে চরমভাবে হতাশ করেছে। এমনকি তরুণ প্রজন্মও দেশ নিয়ে চরমভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। এজন্য তারা সরকারের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নতুনভাবে আবার শুরু করার জন্য। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে আমরা একটা নতুন আমেজ পাচ্ছি। এখানে দেশ নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এ প্রত্যাশা সামনে রেখে আমাদের আবার নতুন উদ্যমে চেষ্টা করতে হবে। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে হবে। কেননা দুর্নীতি আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে, দেশের সর্বনাশ করেছে। হাজার হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার করা হয়েছে। দুর্নীতি যে চরম আকার ধারণ করেছিল, সেখান থেকে যদি বের হতে না পারি তাহলে তরুণ প্রজন্মের এ আত্মত্যাগ আবার ব্যর্থ হবে। আমরা যে যেই অবস্থানে আছি সেখান থেকে দুর্নীতিমুক্তভাবে সমাজের জন্য কাজ করতে হবে।