
একের পর এক ছিনতাই, অপহরণ, ডাকাতির ঘটনায় উদ্বেগ বাড়ছে জনমনে। পুলিশের হিসাব মতে, গত সাত মাসে সারা দেশে বিভিন্ন অপরাধে মামলা হয়েছে ৮৯ হাজার ৩৬৬টি। এসব মামলার বিশ্লেষণে পাওয়া গেছে অপহরণ, ডাকাতি, ছিনতাই ও দস্যুতার মতো ঘটনা অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়েছে।
খুনও হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তবে চুরি, সিঁধেল চুরি ও ধর্ষণের মতো অপরাধ কমেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরাধ মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরও সক্রিয়তা জরুরি। পুলিশের উদ্ধার না হওয়া অস্ত্রগুলো বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করছে। প্রতিটি অপরাধের ঘটনায় মামলা, সঠিক তদন্ত ও অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিতে জোর দিতে হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে অপরাধের মামলা হয়েছে ১৪ হাজার ৫৭২টি ও ফেব্রুয়ারিতে ১৩ হাজার ২টি। গত বছরের আগস্টে ৮ হাজার ৮৩৩টি, সেপ্টেম্বরে ১২ হাজার ২৪৫টি, অক্টোবরে ১৩ হাজার ২৬৫টি, নভেম্বরে ১৩ হাজার ৮২৭টি এবং ডিসেম্বরে ১৩ হাজার ৬২২টি। সাত মাসে জানুয়ারিতে সবচেয়ে বেশি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
৭ মাসের অপরাধের মামলার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছরের আগস্ট থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছিনতাই, ডাকাতি, দস্যুতা, অপহরণ, খুন, চুরি, ধর্ষণ ও সিঁধেল চুরির ১৩ হাজার ৪৯৬টি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। ২০২৩ সালের একই সময়ে এসকল ঘটনায় ১২ হাজার ৭১৪টি অপরাধ সংঘটিত হয়। গত আগস্ট থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডাকাতি হয়েছে ৪২৬টি যা আগের বছরে ছিল ১৮২টি। দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৩৮টি। যা আগের বছরে একই সময়ে ছিল ৭৩৫টি। চলতি বছরের গত দুই মাসে সারা দেশে ১৪৬টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। সেটি গত বছরের একই সময়ে ছিল ৬২টি। গত দুই মাসে দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে ৪২২টি। যা ২০২৪ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ছিল ২৩৫টি। গত সাত মাসে ধর্ষণ, চুরি ও সিঁধেল চুরির অপরাধ কমেছে। সাত মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২ হাজার ৪৫৬টি যা বিগত বছরে একই সময়ে ছিল ২ হাজার ৭২৫টি। গত সাত মাসে চুরির ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ৭৩৪টি যা তার আগের বছরে একই সময়ে ছিল ৫ হাজার ৫২২টি। গত সাত মাসে সারা দেশে খুনের মামলা হয়েছে ২ হাজার ৮৪০টি। তার আগের বছরে একই সময়ে ১ হাজার ৬৮০টি খুনের মামলা হয়েছে।
পুলিশের তথ্যমতে, সারা দেশের এসব মামলার বিশ্লেষণে দেখা গেছে ডাকাতি, ছিনতাই, দস্যুতা খুন, অপহরণ ও নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডাকাতির ঘটনা ৭১টি, দস্যুতা ১৭১টি, খুন ২৯৪টি, ৯১টি, দ্রুত বিচার আইনে মামলা হয় ৯১টি, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ১ হাজার ৪৪০টি, অপহরণ ১০৫টি, পুলিশের ওপর হামলা ৩৮টি, সিঁধেল চুরি ২৬২টি, চুরি-ছিনতাই ৭৯৭টি এবং অন্যান্য ঘটনায় মামলা ৬ হাজার ৬০৩টি। ফেব্রুয়ারিতে ডাকাতির ঘটনা ৭৪টি, দস্যুতা ১৫৩টি, খুন ৩০০টি, ৯১টি দ্রুত বিচার আইনে মামলা, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ১ হাজার ৪৩০টি, অপহরণ ৭৮, পুলিশের ওপর হামলা ৩৭টি, সিঁধেল চুরি ১৯৩টি, চুরি-ছিনতাই ৬৭৩টি এবং অন্যান্য ঘটনায় মামলা ৬ হাজার ৫৮টি। গত বছরের আগস্টে ডাকাতির ঘটনা ৩৭টি, দস্যুতা ৬২টি, খুন ৬২৬টি, ৯৯টি দ্রুত বিচার আইনে মামলা, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ১ হাজার ৭২টি, অপহরণ ২৭, পুলিশের ওপর হামলা ৪১টি, সিঁধেল চুরি ১৩২টি, চুরি-ছিনতাই ৩১৮টি এবং অন্যান্য ঘটনায় মামলা ৫ হাজার ১৬০টি। সেপ্টেম্বরে ডাকাতির ঘটনা ৫৭টি, দস্যুতা ১০৪টি, খুন ২৮৩টি, ১২৮টি দ্রুত বিচার আইনে মামলা, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ১ হাজার ৫৭৮টি, অপহরণ ৬৫টি, পুলিশের উপর হামলা ২৪টি, সিঁধেল চুরি ২৩৩টি, চুরি-ছিনতাই ৬০৫টি এবং অন্যান্য ঘটনায় মামলা ৬ হাজার ৮৯৩টি। অক্টোবরে ডাকাতির ঘটনা ৬টি, দস্যুতা ২০টি, খুন ২৪৯টি, ৯৩টি দ্রুত বিচার আইনে মামলা, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ১ হাজার ৫৬০টি, অপহরণ ৯৬টি, পুলিশের ওপর হামলা ৩৪টি, সিঁধেল চুরি ২৪৮টি, চুরি-ছিনতাই ৭২২টি এবং অন্যান্য ঘটনায় মামলা ৬ হাজার ৩১৮টি। নভেম্বরে ডাকাতির ঘটনা ৪৭টি, দস্যুতা ১৩৩টি, খুন ২১১টি, ৯১টি দ্রুত বিচার আইনে মামলা, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ১ হাজার ৪৫২টি, অপহরণ ৬৭টি, পুলিশের ওপর হামলা ৪৯টি, সিঁধেল চুরি ২৩১টি, চুরি-ছিনতাই ৭১৬টি এবং অন্যান্য ঘটনায় মামলা ৬ হাজার ৪৩২টি। ডিসেম্বরে ডাকাতির ঘটনা ৭১টি, দস্যুতা ১৫৯টি, খুন ২০৪টি, ৯০টি দ্রুত বিচার আইনে মামলা, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ১ হাজার ২০৫টি, অপহরণ ৭৪, পুলিশের ওপর হামলা ৪৪টি, সিঁধেল চুরি ২৩৭টি, চুরি-ছিনতাই ৭২৯টি এবং অন্যান্য ঘটনায় মামলা ৬ হাজার ৩৩৯টি। এ ছাড়া সাত মাসে অস্ত্র আইনে মামলা, বিস্ফোরক আইনে মামলা, মাদক মামলা, পাচার-চোরাচালানের অসংখ্য মামলা হয়েছে।
সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা মানবজমিনকে বলেন, এসব অপরাধকে দমাতে প্রতিরোধ-প্রতিকার জরুরি। যে ঘটনাগুলো ঘটে গেছে সেগুলোকে তদন্ত করে অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। অস্ত্র লুট হওয়ার বিষয়টি উদ্বেগের বিষয়। জননিরাপত্তা রক্ষায় এসব অস্ত্র দ্রুত উদ্ধারে জোর দিতে হবে এবং অভিযান চলমান রাখতে হবে। এগুলো অপরাধীদের হাতে থাকা রাষ্ট্রের জন্য হুমকি, ক্ষতি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, বর্তমান সময়ে ডাকাতি, অপহরণ, খুন, ছিনতাইসহ সব ধরনের অপরাধগুলো অনেক কমে আসার কথা, এটাই আমরা প্রত্যাশা করেছি কিন্তু বাস্তবতা তার বিপরীত। বর্তমানে যে অপরাধগুলো হচ্ছে তার প্রেক্ষাপটে আমরা এটি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেয়ে অপরাধীদের শক্তি অনেক বেড়ে গেছে। দেশে একটি চক্রই তৈরি হয়েছে যারা অপরাধটি তার আয়-উপাজর্নের উৎস মনে করছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অপরাধ দমাতে আরও কঠোর হতে হবে। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর মানবজমিনকে বলেন, সারা দেশে বিভিন্ন অপরাধের ঘটনা ঘটছে। এটি সংখ্যায় কখনো কমে আবার কখনো বাড়ে। দেশে সকল অপরাধের মাত্রা যাতে কমিয়ে আনা যায় এবং অপরাধীর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণে পুলিশ সর্বদা তৎপর রয়েছে।