Image description
যাচাই-বাছাইয়ে তৎপর মন্ত্রণালয় ও জামুকা। তিন মাসে আবেদন পড়েছে ২০ হাজার। ক্ষমা চেয়ে স্বেচ্ছায় সনদ বাতিল চেয়েছেন ১২ জন।

সনদধারী ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের শনাক্তে আবেদনের পাহাড় জমেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। তিন মাসে ২০ হাজারের অধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। ভুয়া সনদে যারা চাকরি নিয়েছেন তাদের নামেও অভিযোগ আসছে। রণাঙ্গনের সম্মুখসারির যোদ্ধারা অভিযোগ জানিয়ে এসব আবেদন করেন। জেলা-উপজেলা থেকে প্রতিদিনই প্রচুর পরিমাণে আবেদন আসছে। এগুলো যাচাই-বাছাইয়ে হিমশিম খাচ্ছে মন্ত্রণালয় ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। যাচাইয়ে প্রাথমিকভাবে সরেজমিন শুনানি হবে। অভিযোগ আসা অব্যাহত থাকলে বাতিলের লক্ষাধিক আবেদন জমা পড়তে পারে। এদিকে সরকারের ডাকে সারা দিয়ে স্বেচ্ছায় ১২ অমুক্তিযোদ্ধা তাদের সনদ বাতিলের আবেদন করেছেন।

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্ত করতে সম্প্রতি ১০ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) ও ১০ সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টি বোর্ড ও নির্বাহী কমিটি পুনর্গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সংশ্লিষ্টরা বলেন, গত সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক নিজেই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ভুয়া সনদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস বিকৃত করে গেছেন। প্রাথমিকভাবে সারা দেশে ৯০ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আছে বলে ধারণা করছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শনাক্তে কাজ করছে স্থানীয় প্রশাসন। তাদের সহায়তা করছেন সেখানকার সম্মুখসারির মুক্তিযোদ্ধারা। ভুয়াদের চিহ্নিত করে একটি ডেটাবেজ তৈরির চিন্তা আছে মন্ত্রণালয়ের। তবে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) মতে, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা লক্ষাধিক। ১৯৯৪ সালে বিএনপির আমলে করা তালিকায় ৮৬ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে মূল ভিত্তি ধরে সামনে এগোতে চায় অধিদপ্তরটি। বর্তমানে দেশের সনদধারী মোট মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৮ হাজার। সে হিসাবে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ২২ হাজার!

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এর ৬ দিন পর অর্থাৎ ১৪ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও তালিকা যাচাই-বাছাইয়ে নির্দেশনা দেন।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম মঙ্গলবার তার কার্যালয়ে অভিযোগের স্তূপ দেখান যুগান্তরের এই প্রতিবেদককে। সেখানে দেখা যায়, প্রতিটি সেলফ, টেবিল, আলমারি অভিযোগের আবেদনে ভরা। দেশের নানা প্রান্ত থেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দিতে এসব অভিযোগ পড়েছে মন্ত্রণালয়ে। সেখানে উপস্থিত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) মহাপরিচালক শাহিনা খাতুন বলেন, অধিদপ্তরেও এমন অভিযোগ জমেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম যুগান্তরকে বলেন, আমরা ধীরে-সুস্থে আবেদনগুলো যাচাই-বাছাইয়ের চেষ্টা করছি। আমাদের মূল লক্ষ্য-একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাও যেন হয়রানির শিকার না হন। তবে যারা ভুয়া সনদ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছেন, তাদের সনদ বাতিল হবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় এসব সনদ দেওয়া হয়েছে। দলীয় বলয় ভারী করতে, অনিয়ম-দুর্নীতি করে অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেওয়া হয়েছে। এটা মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বেইমানি। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করতে ভুয়াদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে যাচাই-বাছাইয়ে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলকে (জামুকা) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা যাচাইয়ে প্রাথমিকভাবে সরেজমিন শুনানি করা হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের মহাপরিচালক শাহিনা খাতুন। বুধবার যুগান্তরকে তিনি বলেন, আমাদের কাছে যে হারে আবেদন আসছে, তা নিখুঁতভাবে যাচাই-বাছাই করতে চাই। আমরা ঢাকায় শুনানির পাশাপাশি সরেজমিন শুনানি করতে চাই। বিশেষ করে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাকে নিয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা এবং যারা অভিযোগ করেছেন, তাদের সঙ্গে বসতে চাই। এতে প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে।

সূত্রে জানা যায়, এখন পর্যন্ত দেশের ভাতাপ্রাপ্ত মোট মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৮ হাজার ৫০। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তের সংখ্যা ৮৯ হাজার ২৩৫ জন। গেজেট বাতিল, মুক্তিযোদ্ধা বয়সসীমা নির্ধারণসহ প্রায় ১৪ ক্যাটাগরিতে মোট মামলার সংখ্যা ২ হাজার ৭১৯টি। ইতোমধ্যে নির্ধারিত বয়সের (১২ বছর ৬ মাস) কম হওয়ায় ২ হাজার ১১১ জন মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল করা হয়েছে। এ নিয়ে বিগত ১৫ বছরে ৩৯২৬ মুক্তিযোদ্ধার গেজেট বাতিল হয়েছে।

কয়েকটি অভিযোগের আবেদনের কপি ঘেঁটে দেখা যায়, শুধু আত্মীয়তার সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন অনেকে। আবেদনকারীর অভিযোগ, আমরা টিম নিয়ে যে অঞ্চলে যুদ্ধ করেছি, সেই টিমের নাম ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়া হয়েছে। অথচ তাকে আমরা চিনি না। অনেক আবেদনে জেলা-উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও স্থানীয় প্রশাসনকে এসব ভুয়া সনদ পাইয়ে দিতে সুপারিশ করেছেন। অর্থের বিনিময়ে দেওয়া হয়েছে এসব সনদ। অনেক অভিযোগকারী জেলা-উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর পেইড এজেন্ট হিসাবে উল্লেখ করেছেন আবেদনে।

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা খ ম আমীর আলী বলেন, রাজনীতির হীন উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ক্ষমতাসীন দলগুলো ৫৪ বছরে মহান স্বাধীনতার অর্জন ভূলুণ্ঠিত করেছে। দলীয় পেশিশক্তি বাড়াতে গিয়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ দিয়েছে। এখন আমরা যারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, তারা অপমানিত, লজ্জিত হচ্ছি। এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানানোর মূল কারিগর ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তিনি টাকার বিনিময়ে এসব ভুয়া সনদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস বিকৃত করে গেছেন। টাকার কাছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে বিক্রি করেছেন। তিনি নিজেও একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বলেই এই মহান সেক্টরটিকে কলুষিত করেছেন।

সূত্রে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধ্যাদেশ সংশোধনের অপেক্ষায় সবাই। এটি সংশোধনের ফাইল কেবিনেট থেকে আরও কিছু সংশোধন চেয়ে ফেরত এসেছে। অধ্যাদেশ সংশোধন হয়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধা ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শনাক্তে আর কোনো বাধা থাকবে না। অধ্যাদেশ সংশোধন হওয়ার পরপরই দ্রুত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রণয়ন করা যাবে।

মুক্তিযোদ্ধা সনদ ফেরত দিতে ১২ আবেদন : মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও মিথ্যা তথ্য দিয়ে সরকারের কাছ থেকে সনদ নিয়েছেন-এমন অন্তত ১২ ব্যক্তি সনদ ফিরিয়ে দিতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন। তাদের মধ্যে আছেন মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়ে অবসরে যাওয়া এক ব্যক্তি। এক ব্যক্তি তার আবেদনে সনদ নেওয়া ভুল হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। দুঃখপ্রকাশ করে ক্ষমা চেয়েছেন কেউ কেউ। তবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সনদ ফেরত দিতে আবেদন করা ব্যক্তিদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হয়নি। কর্মকর্তারা বলছেন, যেহেতু মন্ত্রণালয়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তারা আবেদন করেছেন, নাম প্রকাশ করলে তারা সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হবেন। এ কারণে তাদের নাম গোপন রাখা হচ্ছে।

১১ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও যারা সনদ নিয়েছেন, তাদের তা ফেরত দেওয়ার আহ্বান জানান। তার এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে ২৮ ডিসেম্বর ২ জন অমুক্তিযোদ্ধা তাদের সনদ প্রত্যাহারের আবেদন করেন। যাদের একজন ভারতের লাল তালিকাভুক্ত।