Image description

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে যারা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী, তারা এখন ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহিতার গুরুত্বের দিকে মনোনিবেশ করেছেন। এর মধ্যে গত বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে শাসকের নিরাপত্তা বাহিনীর পূর্ণ শক্তির মুখোমুখি হয়ে যারা রাস্তায় নেমেছিলেন, তারা- যেমন আছেন, তেমনি বলপূর্বক গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, মিথ্যা কারাদণ্ড এবং অন্য অসংখ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হওয়া মানুষও রয়েছেন। এই অপরাধের জন্য দায়ীদের শাস্তি দেখার পাশাপাশি ভুক্তভোগী এবং তাদের পরিবারগুলো সত্য জানতে চায়। সেইসঙ্গে তারা চায় ক্ষতিপূরণ। আরও বিস্তৃতভাবে বলতে গেলে ভবিষ্যত সরকারগুলো অনুরূপ অপব্যবহার যাতে আর না করে, তা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের মানুষ ন্যায়বিচার দেখতে চায়। 

অতীতে ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা অনুসরণের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংস্কারের সূচনা করেছে, এর আইনি ভিত্তির সংশোধন এবং আদালতের অবকাঠামোগত উন্নতির দিকে নজর দিয়েছে। যদিও আরও কিছু করা দরকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মৌলিক ত্রুটিগুলো মোকাবেলার জন্য কৃতিত্বের দাবিদার- যা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটির পূর্বের কার্যক্রমকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।

সরকার এখন দ্বিধাদ্বন্দ্বের মুখোমুখী। দ্রুত বিচারের লক্ষ্যে জনসাধারণের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তব রূপ দেয়ার জন্য সময়ের প্রয়োজন। একই সঙ্গে সাবেক শাসনামলে সংঘটিত হওয়া অপরাধের নেতৃস্থানীয়, বিশেষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা- তিনি বাংলাদেশের বাইরে রয়েছেন। এই বছরের শেষের দিকে কিছু মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তবে বিচারের অনুসন্ধান সম্ভবত অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদের পরেও  চালিয়ে যেতে হবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ কয়েকজন আসামিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সম্পৃক্ত করার বিষয়েও আলোচনা চলছে। একইসঙ্গে বিগত শাসনামলের অপরাধে জড়িত বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহিতার বিষয়টিও রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল।

ন্যায়বিচারের পাশাপাশি সত্যের সন্ধান করতে হবে। এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সের (বলপূর্বক গুম) তদন্ত কমিশনের কাজটি এখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কমিশনের প্রথম অন্তর্বর্তী রিপোর্টে হাসিনা সরকারের রাজনৈতিক বিরোধীদের নীরব করে দেয়ার পদ্ধতিগত প্রচেষ্টার হাড় হিম করা বিবরণ দেওয়া হয়েছে। কমিশন বছরের শেষ নাগাদ একটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার আগে শিগগিরই একটি দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন প্রকাশ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। সম্ভবত অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও কমিশনের অস্তিত্ব বজায় রাখা উচিত কিনা- এই প্রশ্নটি উঠতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে নিখোঁজদের অনেকের ভাগ্য দোলাচলের মধ্যে থেকে যেতে পারে। একটি সম্পর্কিত নোটে বলা হয়েছে, ফৌজদারি অভিযোগের মুখোমুখি হওয়ার ভয় ছাড়াই নিখোঁজদের কী হয়েছে সে সম্পর্কে জ্ঞাত কিছু লোকের থেকে তথ্য জানতে ভবিষ্যতে ট্রুথ কমিশনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে আলোচনা চলছে। যারা অপরাধে জড়িত তাদেরকে কিছুটা ক্ষমা করে দেয়ার বিনিময়ে অপরাধের কথা মেনে নেয়া এবং স্বীকার করে নেয়া সহ সত্য ও পুনরেকত্রীকরণের (ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন) বিষয়গুলো পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কাঁধে পড়তে পারে। 

রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন করার প্রচেষ্টাসহ অতীতের শাসকের অপরাধের কথা মাথায় রেখে, নিরাপত্তা খাত এবং ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন। এই সমস্যাগুলো মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো উত্থাপন করেছে, যেমন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। জুলাই বিপ্লবের সময় সংঘটিত লঙ্ঘনগুলোর বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিসের প্রতিবেদনেও এটি বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৪ সালের শেষের দিকে গঠিত কমিশনগুলোতে পুলিশ এবং বিচার বিভাগীয় সংস্কার নিয়ে আলোচনা শুরু করলেও, পরবর্তী নির্বাচিত সরকার যখন ক্ষমতায় আসবে, তখনও সম্ভবত অনেক কাজ বাকি থাকবে। যা ভাঙতে বছরের পর বছর লেগেছে, তা রাতারাতি মেরামত করা যায় না। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার করাই অন্তর্বর্তী সরকারের মূল লক্ষ্য। প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের সংস্কারের দৃষ্টিভঙ্গি  হলো- সেসব ক্ষেত্র চিহ্নিত করা, যার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আগে থেকেই ঐকমত্য রয়েছে। ২০০৭-০৮ সাল থেকে শিক্ষা নিলে এটা প্রতীয়মান হয় যে, বর্তমান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি হলো পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য এই সংস্কারের কাজ অব্যাহত রাখা। ২০২৫ সালের শেষ থেকে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন হতে পারে। পরবর্তী পরিবর্তন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে সংস্কারকে  বাস্তব রূপ দেবার জন্য হাতে সামান্যই সময় থাকবে।

শেষ পর্যন্ত, ইতিহাস বিচার করবে অন্তর্বর্তী সরকার বিগত সরকারের সময়ের সবচেয়ে খারাপ প্রভাব কাটিয়ে দেশকে একটি সংস্কারের পথে নিয়ে যেতে কতটা সফল হয়েছে, গণতন্ত্রের পথে অতীতের মিথ্যাচার রোধ করতে কতটা সক্ষম হয়েছে। এটি এমন একটি বিষয়- যা বাংলাদেশের সকল বন্ধুদের সমর্থন করা উচিত।

(লেখক জন ড্যানিলোভিজ একজন সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত। বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার সম্পর্ক বিষয়ে গভীর জানাশোনা আছে তার। বর্তমানে তিনি বৈশ্বিক এবং স্থানীয় ইস্যু নিয়ে কাজ করছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে ফিরেছেন। তারপর থেকে দেশটির পরিবর্তিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে যোগাযোগ রাখছেন। তার এ লেখাটি অনলাইন দ্য ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ থেকে অনূদিত)