Image description

Khomenee Ehsan (খোমেনি এহসান)


 
 
জুলাই বিপ্লবকে আমাদের ছাড়া কেউ বিপ্লব বলে না। কেই বলে গণঅভ্যুত্থান, কেউ বলে হাসিনার পতন, কারো কাছে স্রেফ পটপরিবর্তন।
 
দেখুন জুলাই বিপ্লব না বলার মূলে রয়েছে সেনাবাহিনীকে মাইনাস করার বদ মতলব। কারণ জুলাই বিপ্লব বললে বোঝায় সিপাহী-ছাত্র-জনতার বিপ্লব। মানে জুলাই বিপ্লব সম্পন্ন করতে সেনাবাহিনীর অবদান স্বীকার করতে হয়। আর সেনাবাহিনীর অবদান স্বীকার করলে জেনারেল ওয়াকার উজ জামানের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে হয়।
 
এবং জুলাইকে বিপ্লব বলে কবুল করলে সেনাবাহিনীর যে স্বীকৃতি অর্জিত হয় তাতে করে সহজেই প্রশ্ন আসে যে অন্তর্বর্তী সরকারে ভুরি ভুরি বাম সেক্যুলার এনজিও কর্মকর্তা উপদেষ্টা পদ পেলেও সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে মাত্র দুইজন কেন উপদেষ্টা। মানে যারা সংবিধান লঙ্ঘন করে ফাঁসির ঝুঁকি নিয়ে হাসিনার পতন নিশ্চিত করলো তারা মূল্যায়িতই হলো না কেন?
 
আবার এ মূল্যায়নহীনতাও কি শেষ কথা? না। বরং সেনাবাহিনীকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে হেয় করা, ঠুটো জগ্নাথ বানানো এবং স্বাধীনতা-সার্বভোমত্বকে শক্তিশালী সশস্ত্র প্রতিরক্ষার ভিত্তি থেকে সরিয়ে দেওয়াই হলো মতলব। আর এক্ষেত্রে আমরা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকার নিন্দা জানাই। তারা জুলাই গণহত্যার সময়, ৫ আগস্ট এবং পরবর্তী সময়ে জাতীয় সন্ধিক্ষণের কথা বিবেচনা করে বিপ্লবী ছাত্র সমাজ, বিপ্লবী জনতা ও বিপ্লবী সেনাদের মধ্যে একটা পারষ্পরিক শ্রদ্ধা ও আস্থা তৈরিতে ভূমিকা পালন করেননি। এই সুযোগে বিদেশী দালাল ও লোভী লোকজন পরিস্থিতির এমন সুযোগ নিয়েছে যে সেনাবাহিনীকে বিপ্লবের স্টেক হোল্ডারের বদলে উল্টা ভিলেন বানানোরও স্পর্ধা দেখানো হচ্ছে। খেয়াল করে দেখবেন এক পিনাকী ভট্টাচার্যই প্রতিনিয়ত সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকারকে হেয় করে কথা বলে। অথচ তার সঙ্গে সরকারের উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী, বিএনপি জামায়াত এনসিপি নেতাদের যোগাযোগ আছে। এসব লোকেরা কখনোই বলেনি তারা সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের বিরোধী। এমনকি তারা পিনাকীকে কখনো নিন্দা জানায়নি। বরং আমরা কেউ যখন পিনাকীর প্রচারণার সমালোচনা করি তখন তার সংশ্লিষ্ট লোকেরা আমাদেরকে সঙ্ঘবদ্ধভাবে আক্রমণ করে। মাঝখানে ভাবখানা এমন দাঁড়ায় যে অকাল কুষ্মাণ্ডরা সেনাবাহিনী, ডিজিএফআই, র্যাব, এনএসআইকে ভেঙে দিতে বলবে আর সবাই তা চুপচাপ মেনে নেবে। আমরা বলছি এটা ভয়ঙ্কর একটা ব্যাপার যে জাতীয় প্রতিরক্ষা ইনস্টিটিউটগুলোর পক্ষে দাঁড়ানোকে নিন্দনীয় ব্যাপার হিসেবে দেখানো হচ্ছে!
 
তবে আমি খোমেনী ইহসান, আমার দল জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের মধ্যে অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তি নাই। আমরা জুলাই বিপ্লব পরবর্তী প্রথম দল, আমরা জুলাইকে বিপ্লব মনে করি। আমাদের কাছে এ বিপ্লব সিপাহী-জনতার বিপ্লব। আমরা সেনাপ্রধানসহ বিপ্লবের পক্ষের সকল সেনা সদস্যের জুলাই বিপ্লবের অবদান এনডোর্স করি এবং অভিনন্দন জানাই।
 
আমরা বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক। আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে নিজেদের অস্তিত্বের প্রশ্ন মনে করি। তাই জাতীয় প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সকল ইনস্টিটিউটকে দৃঢ়তার সঙ্গে ধারণ করি৷ যদি কোথাও ভুলত্রুটি থাকে তবে তা নিয়ে আমরা কথা বলি মূলতঃ ইনস্টিটিউটকে শক্তিশালী করার একমাত্র উদ্দেশ্য থেকে। হ্যা, আমরা শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ার জায়গায় শক্তিশালী ইনস্টিটিউশন চাই।
 
আমাদের এই চাওয়া কোনো হাওয়াই ব্যাপার নয়। এটি আমাদের অবলিগেশন। বাধ্যবাধকতা। আমরা একটা দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতমুখর দুনিয়ায় বসবাস করি যেখানে আমাদের আত্মপরিচয়ের প্রশ্নটি সবকিছুর উর্ধ্বে। হ্যা, বাংলাদেশ একটি মুসলিম রাষ্ট্র, ১৯৪৭ সালে এর মানচিত্র ইসলামের ভিত্তিতে অর্জিত হয়েছে, এখানকার মুসলমান জনগণ একটা আঞ্চলিক হোস্টাইলিটির ভেতর বসবাস করে। ফলে কেউ যখন বলে আমাদের সেনাবাহিনীকে আঘাত করে, আমাদের ইনস্টিটিউটগুলোকে ভেঙে দিতে বলে তখন আমরা পুরো ব্যাপারটাকে দুনিয়া জুড়ে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে ডিজআর্ম করার প্রকল্পকে ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে দেখি। শত্রুরা যেভাবে চায় মুসলিম রাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্র থাকবে না, জঙ্গী বিমান থাকবে না, রণতরী থাকবে না এবং সর্বোপরি একটি শক্তিমত্তা সম্পন্ন বড় সেনাবাহিনী থাকবে না; সেভাবে কেউ সুর মিলিয়ে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও এর প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে কিছু বললে আমরা তা শত্রুতা হিসেবেই গণ্য করি।
আমাদের সুস্পষ্ট অবস্থান হলো, ৫ আগস্টে সেনাবাহিনী স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুনিশ্চিত করে দেশকে স্থিতিশীল রেখে ট্রানজিশনাল পিরিয়ডকে যেভাবে শান্তিপূর্ণ রেখেছেন তা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। এক্ষেত্রে যে প্রক্রিয়াগত ভুল হয়েছে তার দায় অবশ্যই রাজনৈতিক দল ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের। কারণ তারা শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরেও ট্রানজিশনের কোনো দায়িত্বশীল ও বিশ্বাসযোগ্য প্রস্তাবনা ও পরিকল্পনা জাতির কাছে হাজির করেনি। আবার এদের সামনে আমি জাতীয় বিপ্লবের ইশতেহার পেশ করে ট্রানজিশনের দিক নির্দেশনা হাজির করলেও তারা গ্রহণ করেনি। কাজেই দোষ হলো রাজনীতিকদের। ১৬ বছর ধরে এরা একটা ফ্যাসিবাদ মোকাবিলা করেছে অথচ এই ফ্যাসিবাদ থেকে উত্তরণ ও ফ্যাসিবাদের পতন হলে দেশ পুনর্গঠনের কোনো প্রস্তাবনা ও পরিকল্পনা এদের ছিল না। এমনকি ছাত্ররাও কোথাও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা পেশ করেনি।
 
এ অবস্থায় সেনাবাহিনীর করণীয় কী ছিল? সংবিধান মানলে সেনাবাহিনীর কর্তব্য ছিল হাসিনাকে রক্ষায় জনগণের ওপর শেষগুলিটি করা। এমনটি একাত্তরে পাকিস্তান আর্মি করেছিল বলেই এখানে গণহত্যার পরিস্থিতি তৈরি হয়। যার কারণে আমরা কত লাখ মানুষকে হারিয়েছি! বিনিময়ে ৪৭ এর মানচিত্রের ওপর স্বাধীনতাকে কনসলিডেট করতে পারলেও জনগণের বিপুল অংশ বিভক্ত ও দেশ ভারতের হস্তক্ষেপযোগ্য হয়ে আছে৷ আজ একাত্তরের ৫৩ বছর পরও কিশোর তরুণদের এক বড় অংশের মধ্যে নিজ জাতির ভাই ও বোনদের পর করে রাখা ফ্যাশন বিবেচিত হচ্ছে।
 
কাজেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সংবিধান রক্ষার দোহাই দিয়ে যে দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়নি এটি ছিল সবচেয়ে বড় দেশপ্রেমের পরিচয়। দ্বিতীয়ত সেনাবাহিনী সামরিক শাসন জারির ভুল পথে না গিয়ে রাজনীতিক ও ছাত্রজনতাকে আস্থায় নিয়ে বেসামরিক সরকার গঠনে সহায়তা করেছে।
এক্ষেত্রে বলা দরকার, সামরিক শাসন জারির পরিকল্পনা ছিল পলাতক হাসিনার বশংবদ ও ভারতপন্থী জেনারেল মুজিবের, আবার দালালদের দিয়ে বি টিম সরকার গঠনের পরিকল্পনা ছিল জেনারেল হামিদুল হকের। কিন্তু সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার বরাবরই গণতান্ত্রিক উত্তরণের পক্ষে আছেন। তিনি ১৮ মাসের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন ও জাতীয় নির্বাচনের কথা বলেছেন, এতেতো ভুল নাই৷ কারণ আমরা বলেছি নতুন সংবিধান প্রণয়নসহ সকল সংস্কার সম্পন্ন করে জাতীয় নির্বাচন দিতে এক বছর যথেষ্ট ছিল। সে হিসাবে সেনাপ্রধান ১৮ মাসের কথা বলে ছয় মাস বেশি সময় দিয়েছেন। আমরা বিশ্বাস করি বিএনপি ও জামায়াত ক্ষমতার লোভ না করে সংস্কারে সম্পৃক্ত হলে পরিবর্তনের জন্য এক বছরেরও কম সময় লাগতো।
 
আমরা কাউকে দেখিনি এটি বলতে যে সংস্কার কমিশনগুলোর কাজ করার জন্য দুই সপ্তাহও লাগে না, অথচ তারা সরকারি পয়সা খরচ করে মাসের পর মাস লাগিয়েছে। আবার আসিফ নজরুলসহ কেউ কেউ আছে যারা অন্তর্বর্তী উপদেষ্টার দায়িত্বের বদলে রাষ্ট্রযন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নিজেদের লোক ঢুকানো নিয়ে ব্যস্ত। এরা এতটাই উন্নাসিক যে জাতীয় সন্ধিক্ষণের সরকারে বসে কয়েকশত বছর আগে মারা যাওয়া মোগল রাজপুত্র দারাশিকোকে প্রতিষ্ঠার জন্য গো ধরেছে। মাঝখান থেকে কোটি কোটি টাকায় লোক নিয়োগ বদলি, পুরনো লুটেরাদের পুনর্বাসনে শত শত কোটি টাকার লেনদেন চলছে। এমনকি একটা ইউপি নির্বাচনে পাশ করার গণভিত্তি ছাড়া আসন ভাগাভাগিও করছে। মাঝখান থেকে ফুটপাথ টেম্পুস্ট্যান্ড থেকে ব্যাংক বীমায় দখলদারি কায়েম হয়ে গেছে। নারীরা ধর্ষণ, হেনস্থা, মারধরের শিকার হচ্ছে। উগ্রবাদীরা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে জনপরিসরে দম্ভের সঙ্গে উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।
 
এ অবস্থার মধ্যেই সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেসের উপস্থিতিতে যেভাবে একসঙ্গে মিলে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন তাতে আশাবাদী হতে হয়। আমেরিকা ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক হচ্ছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন সঙ্কট দূর হচ্ছে। আমরা আসিয়ানের সদস্য হতে যাচ্ছি। ভারতের হস্তক্ষেপ বন্ধ হলেও সুসম্পর্কের জায়গাটা বজায় আছে। এরমধ্যে স্বস্তি হলো জনগণ ১৬ বছর পর একটা স্বস্তির রমজান ও ঈদ পার করছে। সর্বত্র এক নতুন বাংলাদেশের জাগরণ দেখা যাচ্ছে।
 
আমাদের স্পষ্ট কথা, বাংলাদেশ ঠিকপথে আগাবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে যতটুকু সময় আছে তার মধ্যে সংস্কার ও রিকন্সিলিয়েশন হবে। ইনশাআল্লাহ সরকার ও সেনাবাহিনী এমন একটা গণতান্ত্রিক দেশ উপহার দেবে যেখানে জাতীয় বিপ্লবী পরিষদসহ নতুন রাজনৈতিক দলগুলো অবাধে রাজনীতি করে দেশকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিতে পারব। আমরা রাজপথ থেকে রাজনীতি গড়ছি, রাজপথে থেকেই এগিয়ে যাব। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব, জুলাই বিপ্লব, জনগণ ও সেনাবাহিনীকে আমরা অভিন্ন মনে করি।
 
আমরা বিশ্বাস করি জনগণ জুলাইকে বিপ্লব হিসেবে গ্রহণ করবে এবং ছাত্রজনতার পাশাপাশি সেনাবাহিনীর অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে সবাইকে রাষ্ট্র পরিচালনায়ও সম্পৃক্ত করবে, এটি তথাকথিত সামরিক শাসন নয় বরং আমেরিকার-চীন-ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর মতো ব্যবস্থা।